USA

হিন্দু-মুসলিম অঙ্কে আবর্তিত মার্কিন ভোট?

রাত পোহালেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচার বাংলাদেশের সংকট, ইজরায়েল-প‌্যালেস্তাইন দ্বন্দ্ব–আবিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভাষ্যে সরগরম। 

একদিকে ট্রাম্পের প্রবাসী হিন্দু-ভোট টানার প্রচেষ্টা, অন‌্যদিকে কমলা হ‌্যারিসের কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা, অনাবাসী এশীয় সর্বোপরি নারী পরিচয় তাকে এগিয়ে রাখছে না কিছু কম। কিন্তু এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এতই টানটান, শেষ মুহূর্তে যা কিছু ঘটতে পারে।

হিন্দু, মুসলিম। ভারতীয় রাজনীতি গত তিন দশক ধরে যে-দু’টি শব্দের ‘অক্ষ’-য় ঘুরপাক খাচ্ছে, এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও কি সেই ‘অক্ষ’-তে পড়ে গেল? এমনতর মনে হওয়ার কারণ, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডেমোক্র্যাট-প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে ‘হিন্দু বিদ্বেষী’ বলে দেগে দিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের উল্লেখ করা। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট অবশ্য এখানেই থামেননি, একেবারে অতি দক্ষিণপন্থীদের আদলে কমলা হ্যারিস ও ডেমোক্র্যাটদের র‌্যাডিক্যাল লেফট বা অতি বামেদের মদতদাতা বলে নিশানা করে হিন্দুদের স্বার্থ উপেক্ষা করার অভিযোগ এনেছেন। ট্রাম্পের দাবি, তিনি হোয়াইট হাউসে ফিরলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে শুধু নয়া দিল্লি ও ওয়াশিংটনকে কাছে আনবেন না, হিন্দুদের স্বার্থ-রক্ষার্থেও উদ্যোগী হবেন। যদি আমরা একে অতি দক্ষিণপন্থীদের এক ‘ব্র্যাকেট’-এ আসা বলে ধরে নিই, তাহলে তার বিপরীতে মার্কিন নির্বাচনে তথাকথিত প্রগতিশীলরা কি একটু ছন্নছাড়া?

অবশ্যই। বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইজরায়েল নীতি এবং ‘ইহুদি বধূ’ কমলা হ্যারিসের প্যালেস্তাইন নিয়ে মুখ না-খোলা মার্কিন প্রবাসী মুসলিমদের যথেষ্ট বিরক্ত করে রেখেছে। বিশেষ করে আরব
মুসলিমদের। ডেমোক্র্যাট দলে যারা প্রগতিশীল বলে পরিচিত, তারা গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে হেরেছেন ইহুদি লবির কাছে। তাই ২০২০-তে যেমন আরব মুসলিমরা উপুড় করে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়েছিলেন, এবার তেমন হওয়ার সম্ভাবনা কম। মুসলিমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে ‘সুইং স্টেট’-গুলিতে কমলা হ্যারিসের পক্ষে জেতা মুশকিল হতে পারে। তাহলে ট্রাম্প হিন্দু বন্ধু আর কমলা হ্যারিস মুসলিম বিদ্বেষী- এই প্রতর্কই কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে? না, সেই সঙ্গে আরও অনেকগুলি কারণ রয়েছে।

কারণ-১: 

মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাত নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পর সে-দেশে মহিলাদের মধ্যে যে-পরিমাণ রক্ষণশীল বা
রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে, তার যদি বহিঃপ্রকাশ ভোটের দিন ঘটে, তাহলে কমলা হ্যারিস প্রথম মহিলা রূপে পৌঁছে যাবেন হোয়াইট হাউসে। মনে রাখতে হবে, হ্যারিস শুধু কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা বা অনাবাসী
এশীয়দের মধ্যে সমর্থনের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছেন তা-ই নয়, তিনি শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের মধ্যেও অনেক
পয়েন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক ভোটের মতো মার্কিন নির্বাচনেও যদি মহিলাদের ভোটই নির্ণায়ক হয়, তাহলে প্রথম কালার্ড উইমেন হিসাবে জামাইকান বাবা এবং দক্ষিণ ভারতীয় মায়ের সন্তানের হোয়াইট হাউসে পৌঁছে যাওয়াটা অবধারিত।

কারণ-২:

পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, ‘এক্স’-এর মালিক এলন মাস্কের আচমকাই ‘প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে প্রচারে নেমে যাওয়া। মাস্ক যে ‘পলিটিকাল অ্যাকশন কমিটি’ (পিএসি) তৈরি করেছেন এবং যারা ওই ‘সুইং স্টেট’-গুলিতে ট্রাম্পের হয়ে প্রচার করছেন, তারা কতটা খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারবেন, তা কেউ জানে না। মার্কিন নির্বাচনে বা রাজনীতিতে এভাবে তৃতীয় কোনও পক্ষের প্রবেশ বা প্রচারের দায়িত্ব নেওয়া অভাবনীয় ঘটনা। রবিবার সকালেও দেখলাম, ‘দ্য নিউইয়র্ক  টাইমস’ কিংবা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলতে পারছে না, মাস্ক কিংবা অন্য ধনকুবেররা এই ‘পলিটিকাল অ্যাকশন কমিটি’-গুলির পিছনে ঠিক কত কোটি ডলার খরচ করছেন! মার্কিন মুলুকে ‘পিএসি’-র স্বেচ্ছাসেবকেরা কতজন ভোটারের বাড়ি পৌঁছতে পারছেন, তাদের কতটা প্রভাবিত করেছেন– সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কারণ-৩:

আলটপকা মন্তব্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিউ ইয়র্কের মিছিল থেকে পুয়ের্তো রিকো-র অধিবাসীদের নিয়ে জাতিবিদ্বেষী রসিকতা, আর আচমকা জো বাইডেনের রিপাবলিকান সমর্থকদের আবর্জনা বলা। এই দু’টি
মন্তব্যই এসেছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগের সপ্তাহে। দুই শিবিরের প্রচারাভিযান এবং একে-অপরকে বিদ্বেষের রাজনীতিতে অভিযুক্ত করায় সাহায্য করেছে আলটপকা মন্তব্য। বাইডেনের মন্তব্য, তার ভাইস
প্রেসিডেন্টের শেষ মুহূর্তের সব মিছিলের চেয়ে বেশি শিরোনাম পেয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের মিছিল থেকে এক কৌতুকাভিনেতার পুয়ের্তোরিকানদের নিশানা করাও কম এয়ার টাইম নেয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে
আলটপকা মন্তব্য যে নির্বাচনের ভারসাম্যকে কতটা বদলে দিতে পারে, তা মার্কিন নির্বাচনের অন্তিম প্রহর দেখাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পেনসিলভেনিয়ার মতো ‘সুইং স্টেট’, যেখানে ‘সুইং স্টেট’-গুলির মধ্যে ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’-এ সবচেয়ে বেশি ভোট রয়েছে এবং যে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ এবার ট্রাম্পের দিকে ঢলেছিল, তাতে যথেষ্ট পুয়ের্তো রিকোর মানুষজন থাকেন। একজন কৌতুকাভিনেতার জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য যদি পেনসিলভেনিয়াকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে আবার কমলা হ্যারিসের দিকে ফিরিয়ে আনে, তাহলে রিপাবলিকানদের কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।

রাত পোহালেই যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, যে-ভোটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আবিশ্ব, সেই ভোটের ফলাফল তাহলে কী হতে চলেছে? এখনও পর্যন্ত আমেরিকার মতামত সমীক্ষা অনুযায়ী, কমলা হ্যারিস ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে মাত্র ১ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এতই টানটান, শেষ মুহূর্তে যা কিছু ঘটতে পারে। আর কে না জানে, সব মতামত সমীক্ষাকে উড়িয়ে দিয়ে সবসময়ই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রত্যাশার চেয়ে ভাল ফলাফল করেন। এবারও যে ৭টি ‘সুইং স্টেট’-এর উপরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করছে, তার ৫টিতেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্লা ভারী। হোয়াইট হাউসে পৌঁছতে গেলে মিশিগান এবং উইসকনসিন– যে দু’টিতে হ্যারিস আপাতত এগিয়ে, শুধু সেই দু’টি প্রদেশে জিতলে হবে না, তাকে পেনসিলভেনিয়াও জিততে হবে।

মার্কিন নির্বাচনকে বুঝতে গেলে, সে-দেশের অদ্ভুত নির্বাচন পদ্ধতিকে একটু হলেও জানতে হবে। আমেরিকার ৫০টি প্রদেশের সবাই ভোট দেয়। কিন্তু নির্বাচনের প্রথা অনুযায়ী, কোনও একটি প্রদেশে যিনি জেতেন, তিনি ওই প্রদেশের ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’-এর সব ভোট পান। এইভাবে ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’-এর ভোট পেতে-পেতে প্রেসিডেন্ট হতে গেলে অন্তত ২৭০টি ভোট পেতেই হয়। মার্কিন মুলুকের প্রদেশগুলির অধিকাংশেরই ভোটদানের প্রবণতা এবং তারা কোন পক্ষকে সমর্থন করতে পারে তার ধারাবাহিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে  ধরে নেওয়া হয় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’-এর অন্তত ক’টি ভোট পাবেন, বা রিপাবলিকানরাও ক’টি পেতে পারেন।

সেই অনুযায়ী, আমেরিকার ৪৩টি প্রদেশের ভোটদানের প্রবণতা দেখে ধরে নেওয়া হচ্ছে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী রূপে কমলা হ্যারিস ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’-এর অন্তত ২২৬টি ভোট পাবেনই। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২১৯টি। তাহলে ওই ৭টি ‘সুইং স্টেট’-এর ভোটই ঠিক করে দেবে কে পৌঁছবেন হোয়াইট হাউসে। জিততে হলে কমলা হ্যারিসকে ওই ৭টি ‘সুইং স্টেট’ থেকে অন্তত ৪৪টি ভোট পেতেই হবে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের দরকার কমপক্ষে ৫৪টি ভোট। যদি কমলা হ্যারিস ডেমোক্র্যাটদের রাজ্যগুলিকে ধরে রেখে আরও ৪৪টি ভোট জোগাড় করতে পারেন, তাহলে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে কম ব্যবধানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতবেন। সেক্ষেত্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস পেতে পারেন ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’-এর ২৭০টি ভোট, আর ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৬৮।

নির্বাচনের ফলাফল কি এরকমই কঠিনতম লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে? এখনও পর্যন্ত তা-ই। কিন্তু গত তিনটি
মার্কিন নির্বাচনই চমক দেখিয়েছে। তাই এবারেও সেরকম কিছু প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য যারা বিখ্যাত, তারা অবশ্য ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, শেষ মুহূর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাজিমাত করে বেরিয়ে যাবেন! আবার উল্টোদিকে বিভিন্ন মতামত সমীক্ষা বলছে, ‘রিপাবলিকানদের দুর্গ’ বলে পরিচিত বিভিন্ন প্রদেশেও কমলা হ্যারিস এগিয়ে যাচ্ছেন। যেমন, আইওয়া। তাই এই টানটান স্নায়ুযুদ্ধের খেলায় কে জিতবেন, ভোট-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে কি সত্যিই ওয়াশিংটন ভাববে, বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানে হোয়াইট হাউস কতটা উদ্যোগী হবে, তা বুঝতে আমাদের হয়তো আর ৭২ ঘণ্টার অপেক্ষা।

২০২০-র পরাজয়, তার বিরুদ্ধে ক্যাপিটাল হিল আক্রমণে মদত দেওয়ার অভিযোগ, পরিবেশ ভাবনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা– এসব কিছুকে অতিক্রম করে ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখাচ্ছেন, ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’।
তেমনই, কমলা হ্যারিস জো বাইডেনের কেঁচিয়ে দেওয়া খেলাকে ডেমোক্র্যাটদের অনুকূলে আনতে মরিয়া। লড়াই তাই টানটান, মস্কো থেকে নয়া দিল্লি অধীর আগ্রহে তাকিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d