Bangladesh

হিসাব না দিলেই মামলা

সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী চেয়ে প্রজ্ঞাপন বিচার বিভাগ-সিভিল প্রশাসন-পুলিশ প্রশাসনসহ সর্বত্রই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ

সরকারি চাকরিজীবী মানেই অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক। কয়েকদিন আগে সাবেক সচিব শাহ কামালের বাসা থেকে কোটি ১০ লাখ ক্যাশ টাকাসহ কয়েক কোটি টাকার সোনাদানা উদ্ধার করা হয়। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমদ, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমদ, ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, এনবিআরের মতিউর রহমান, ডিবির হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেল খ্যাত হারুনুর রশিদসহ অনেক সাবেক কর্মকর্তার ধনসম্পদের পাহাড়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। কয়েকদিন আগে চাকরিচ্যুত হওয়া পুলিশের মনিরুল ইসলাম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশের মধ্যে ভাগ করে দিতে গণভবন থেকে ২৫ কোটি টাকা এনেছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ পতিত হাসিনার অবৈধ আদেশ-নির্দেশ পালন করায় ১৫ বছর সিভিল প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফ্রি স্টাইলে দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। পতিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ‘টাকা পাচার করে কানাডার বেগম পাড়ায় বাড়ি করেছেন ৩২ জনের মধ্যে ২৮ জন আমলা-ব্যবসায়ী’। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালনোর পর মন্ত্রী এমপিদের মতোই বিতর্কিত আমলারা অত্মগোপন করে। আমলা পুলিশের অনেকেই বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর নির্দেশনার পরও অনেকেই কাজে যোগদান করেননি। নানাপন্থায় তারা পালানোর চেষ্টা করছেন।

হাসিনার পালানোর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পুলিশ ও আমলাদের বিপুল বিত্তবৈভবের খবর প্রকাশ হতে থাকে। নেটিজেনদের অনেকেই বলেছেন, উর্ধ্বতন আমলারা গড়ে সাকুল্যে এক লাখ টাকা বেতনের চাকরি করে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। শেখ হাসিনার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়া আমলাদের টাকার পাহাড়ের সন্ধানে তাদের বাসাবাড়িতে অভিযান চালাতে দুদকের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন। এমন অবস্থায় গতকাল সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, সকল সরকারি কর্মচারীকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৪ আগস্ট স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাখিলের এ জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তের পর চাকরিজীবীদের সেই হিসাব কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে একটি ফরম্যাট প্রস্তুত করা হবে। জনপ্রশাসনের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন-পুলিশ প্রশাসনসহ সর্বত্রোই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার রেজিমে প্রতিটি সেক্টর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীর নিজ সম্পদ বিবরণী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার কথা। তবে চাকরির সেই আচরণবিধি আদতে মানছেন না কেউ। সম্পদের হিসাব দিতে আগ্রহী নন সরকারি চাকরিজীবীরা। আবার তাদের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থারও হিসাব নেওয়ার ব্যাপারে কোনো উদ্যাগ দেখা যায়নি। দু’পক্ষের অনীহায় হিসাব দেওয়ার বিষয়টি অনেকটাই ‘কাগজে নিয়ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি তাদের অধীন কর্মকর্তাদের দায়সারা হিসাব নেয় বটে, কিন্তু সেগুলো খতিয়ে দেখা হয় না। কারও অস্বাভাবিক সম্পদ বেড়ে গেলেও ব্যবস্থা নেওয়ার নজির গত ১৬ বছরে নেই। বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেবার পর এক মাসের মধ্যে বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সরকারি সব চাকারিজীবীকে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল করার নির্দেশনা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

এদিকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তোলার স্বার্থে এ আচরণবিধি কঠোর ও কঠিনভাবে সরকারের প্রয়োগ করা উচিত। ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী অন্য মন্ত্রণালয় নিশ্চুপ থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেহেতু আচরণবিধি জারি করেছে, তাই তাদের মুখ্য ভূমিকা নেওয়া উচিত। আচরণবিধি না মানলে তা অসদাচরণ। তাই সম্পদের হিসাব না দিলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা উচিত বলে মনে করছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এমপি, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ ও এনবিআর থেকে বদলি হওয়া কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর থেকে সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাবের বিষয়টি ফের সামনে আসে। প্রশাসন ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি তাদের অধীন কর্মকর্তাদের দায়সারা হিসাব নেয় বটে, কিন্তু সেগুলো খতিয়ে দেখা হয় না। কারও অস্বাভাবিক সম্পদ বেড়ে গেলেও ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। তবে বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেবার পর এক মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। সদ্য সাবেক সরকারের মন্ত্রী এমপি, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ ও এনবিআর থেকে বদলি হওয়া কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর থেকে সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাবের বিষয়টি ফের সামনে এসেছে। তবে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সুযোগ-সুবিধাভোগকারী সচিবরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আবার অনেকই অবসরে গেছেন তাদের সম্পদের হিসাব কি ভাবে নেয়া হবে বলা হয়নি। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি বেড়েছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআই)।

জানা গেছে, পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান ১৯৭৯ সালে চালু হয়। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী আছেন। চাকরিজীবীর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আচরণ বিধিমালায় এ নিয়ম যুক্ত করা হয়। তবে চার দশকের বেশি সময় ধরে এ নিয়ম পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। অতীতে দেখা গেছে, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় তাদের অধীন কর্মচারীর কাছে সম্পদের বিবরণী চেয়েও তেমন সাড়া পায়নি।

জানা গেছে, নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে সরকারি কর্মচারীর ওপর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো চাপই নেই। ফলে এ সম্পদের প্রশ্নে স্রোতে গা ভাসিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সম্পদের হিসাব জমা দিতে কড়া নির্দেশ দেওয়া হলে সে সময় সব কর্মচারী তা দিয়েছিলেন। নানা দিকে আলোচনা উঠলে ২০১৫ সালে আরেক দফা সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দিতে সরকার থেকে বলা হয়। তখন গুটিকয়েক মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ন্ত্রিত কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নিতে পারলেও বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে সরকারি চিকিৎসকদের সম্পদের হিসাব চাওয়া নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তখন বেশ বিপাকে পড়ে। চিকিৎসকের মধ্য থেকে এর জোরালো প্রতিবাদও ওঠে। সরকারি কর্মচারীকে আচরণবিধি মানাতে না পেরে গত বছরের শেষের দিকে এ নিয়ম বদলে ফেলার উদ্যোগ নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরে আচরণবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা (ধারা-১২ ও ১৩) সংশোধনের বিষয়টি সমালোচনার মুখে পড়লে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়। একইভাবে মন্ত্রী-এমপির সম্পদ বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা দীর্ঘদিন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে প্রার্থী হিসেবে অনেকে যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে তা প্রকাশ করা হয় বটে। তবে সেখানে সম্পদের যে বিবরণ থাকে, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে। সরকারি কর্মচারী আইন (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি ১২ ও ১৩ অনুসারে সরকারি কর্মচারীর স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রি ও সম্পদ বিবরণী জমার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ যে কোনো সম্পদ কিনতে বা বিক্রি করতেও সরকারের অনুমতি নিতে হয় তাদের। সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে টাকার উৎস সম্পর্কেও জানাতে হয়। আবার সম্পদ বিক্রি করা হলে দাম জানাতে হয়। কারণ, কমবেশি দামে সম্পদ বেচাকেনা হলো কিনা, তা যাচাই করার সুযোগ রাখা হয়েছে। অভিযোগ আছে, একশ্রেণির সরকারি কর্মচারী তাদের আয়কর রিটার্ন বা এনবিআরে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে প্রকৃত সম্পদ দেখান না, বেনামে সম্পদ লুকিয়ে রাখেন। প্রতিটি আয়কর রিটার্ন ফরমের সঙ্গে আইটি ১০বি নামে একটি আলাদা ফরম থাকে। ওই ফরমেই সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হয়। সম্পদ বিবরণী জমার তিনটি শর্ত আছে। সে অনুযায়ী সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকা পার হলে, গাড়ির মালিক হলে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় জমি-বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট থাকলে সম্পদ বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে চাকরিতে ঢোকার সময় নবীন কর্মকর্তারা শুরুতেই তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দেন। প্রতি পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হিসাবও তারা দেন। তবে অন্য ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়গুলো এ নিয়ে উদাসীন থাকায় তাদের কর্মকর্তারা সম্পদের হিসাব দেন না।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, নিয়ম অনুসারে প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরে সরকারি কর্মচারী তাদের সম্পদের হিসাব জমা দেবেন। স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তোলার স্বার্থে এ আচরণবিধি কঠোর ও কঠিনভাবে সরকারের প্রয়োগ করা উচিত। ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী অন্য মন্ত্রণালয় নিশ্চুপ থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেহেতু আচরণবিধি জারি করেছে, তাই তাদের মুখ্য ভূমিকা নেওয়া উচিত। আচরণবিধি না মানলে তা অসদাচরণ। তাই সম্পদের হিসাব না দিলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা উচিত।

এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, লাখ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর আয়কর রিটার্ন খতিয়ে দেখার মতো সক্ষমতা সরকারের কোথায়? সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য সরকারি চাকুরের মধ্যে তদারকি ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor