Jannah Theme License is not validated, Go to the theme options page to validate the license, You need a single license for each domain name.
Bangladesh

হোটেল শাহবাগ: এক বাড়ির তিন কাল; নাচঘর, হোটেল, হাসপাতাল

হোটেলটি অবশ্য বেশিদিন আয়ু পায়নি। তবে ষোল-সতের বছরে কম ইতিহাস তৈরি করেনি। তার অনেকটাই অনেকে মনের কুঠুরিতে বন্দি করে করাচি, ইস্পাহান, নিউ ইয়র্ক বা সিডনিতে নিয়ে গেছেন। যারা যাননি তারা আর ঘেঁটে কী হবে ভেবে সময় শেষ করে ফেলেছেন। 

হোটেলটি অবশ্য বেশিদিন আয়ু পায়নি। তবে ষোল-সতের বছরে কম ইতিহাস তৈরি করেনি। তার অনেকটাই অনেকে মনের কুঠুরিতে বন্দি করে করাচি, ইস্পাহান, নিউ ইয়র্ক বা সিডনিতে নিয়ে গেছেন। যারা যাননি তারা আর ঘেঁটে কী হবে ভেবে সময় শেষ করে ফেলেছেন। 

হোটেল শাহবাগ রূপান্তরিত হয়েছে আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বা পিজি হাসপাতালে। ছবি: সংগৃহীত

দেশভাগের পর ঢাকা ফিরে পেল রাজধানীর মর্যাদা। কিন্তু রাজধানীতে থাকার জায়গার বড় অভাব। ভালো মানের কোনো হোটেলই তখন ছিল না। অথচ পাকিস্তানজুড়ে তখনো কত কত নাইট-নওয়াব! কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তারাও কাজে-অকাজে আসবেন, তাদেরও থাকতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান সরকার সিদ্ধান্ত নিল শাহবাগে একটি হোটেল গড়া হবে। তিন তারকা হোটেল, নাম হবে ‘হোটেল শাহবাগ’।

ফুর্তিবাড়ি ইশরাত মঞ্জিল

শাহবাগে নবাবদের একটি আনন্দবাড়ি ছিল, যার নাম ‘ইশরাত মঞ্জিল’। আদতে এটি ছিল ফুর্তিবাড়ি, মনোরঞ্জনের এক দুনিয়া। সেখানে চিত্তবিনোদনের নানা আয়োজন থাকত। বেঙ্গালুরু থেকে পিয়ারী বাই, হীরা বাই, আবেদী বাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হতো। তারা নাচ-গানে নবাবদের মুগ্ধ রাখতেন।

এ মঞ্জিলে পদার্পণ করেছিলেন লর্ড ডাফরিন, লর্ড কারমাইকেল, স্যার স্টুয়ার্ট বেইলি, স্যার উডবার্ন প্রমুখ। এখানে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে যায় যা ভারতকে ভেঙে দু’টুকরো করে দেয়। সেটি হলো মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা।

১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ ইশরাত মঞ্জিলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’। সারা ভারত থেকে চার হাজার প্রতিনিধিকে এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে সেদিন কেউ নিশ্চয়ই ভাবেননি যে, এ দলটিই অন্নদাশঙ্কর রায়কে ব্যথিত করবে এবং তিনি লিখবেন তার বিখ্যাত ছড়া, ‘তোমরা যে সব বুড়ো খোকা, ভারত ভেঙে ভাগ করো…।’

সে সময় শাহবাগ ছিল শান্ত, পাতা পড়লেও আওয়াজ শোনা যেত। কিন্তু যেদিন মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলো, সেদিন সম্ভবত আশপাশে বাদামওয়ালা, মুড়িওয়ালাদের ভিড় জমে গিয়েছিল। ইতিহাস অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো সাক্ষ্য দেয় না।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে নবাব সলিমুল্লাহর মনও ভেঙে খান খান হয়ে যায়। অন্যদিকে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ চলে যায় জিন্নাহ ও তার গংদের দখলে। সে শোক সইতে না পেরে কিছু বছর পরে সলিমুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। বাংলায় মুসলিম লীগের নেতৃত্ব অবশ্য ঢাকার নবাবদের হাতেই থেকে যায়। দেশভাগের পরও সে ধারাবাহিকতায় খুব একটা ছেদ পড়েনি। নবাবরা তা টিকিয়ে রাখতে নানান রকম দান-ধ্যানও করতেন।

১৯৫১ সালে হোটেল শাহবাগের মডেল সামনে রেখে ঠিকাদার ও অন্যরা। ছবি সৌজন্য: ইমতিয়াজ আহমেদ

পূর্ব পাকিস্তান সরকার যখন একটি আবাসিক হোটেল গড়ার কথা তোলে, তখন নবাবরা ইশরাত মঞ্জিল ছেড়ে দেন। পঞ্চাশের দশকের ঢাকা গুলিস্তান থেকে আরও উত্তরে বিস্তৃত হতে শুরু করে। রমনা রেসকোর্স তখন থেকেই ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মিন্টো রোডে বঙ্গভঙ্গের পরপর গড়ে উঠেছে লাল রঙের সুরম্য সব বাংলো। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই শাহবাগ যে ঢাকার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে, তা অনুমান করা কঠিন ছিল না।

সরকারি শাহী হোটেল

হোটেল তো তৈরি হবে, তার আগে নকশা প্রয়োজন। ব্রিটিশ স্থপতি এডওয়ার্ড হিকস এবং রোনাল্ড ম্যাককনেলকে এ কাজের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন মানুষ কম, জায়গা বেশি ছিল। ফলে স্থপতিরা নকশা করতে পারতেন হাত খুলে।

মওলা বখশ সরদারের ছেলে আজিম বখশ এখন আশি পেরুতে চলেছেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ঢাকা কেন্দ্র’। ষাটের দশকে বাবার সঙ্গে তিনি শাহবাগ হোটেলে গিয়েছিলেন, আতিথ্য নিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত এক কিরমানির রুমে। রুমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।

সমাজ-বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের গবেষক হোসাইন মোহাম্মদ জাকি ‘যুগান্তর’ পত্রিকার ১৯৫২ সালের ১ এপ্রিল সংখ্যাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। যুগান্তরের লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘সরকারী শাহী হোটেল’। বর্ণনায় বলা হয়েছে: ‘রমনা ঘোড়-দৌড়ের মাঠের নিকট এক বছরের অধিক হলো এক সুবৃহৎ বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। এই দালানটির কাজ সম্পূর্ণ হলে এটি হবে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ হোটেল। এক লাখ তেইশ হাজার একশ চব্বিশ বর্গফুট স্থানব্যাপী এ হোটেলটি তৈরি হচ্ছে। চারতলা বিশিষ্ট এ হোটেলে একটি লোকের বাসযোগ্য ১৩ ফুট ৪ ইঞ্চি দীর্ঘ এবং ১২ ফুট প্রস্থ ৭১ এবং দুজনের বাসযোগ্য ১৫ ফুট দীর্ঘ ও ১৩ ফুট ৪ ইঞ্চি প্রস্থ ২৬টি কক্ষ থাকবে। প্রত্যেক কামরার সঙ্গে যুক্ত থাকবে একটি করে ভিজিটিং রুম।’

যুগান্তরের ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ ছিল, হোটেলে অতি আধুনিক ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রণালীর রান্নাঘর থাকবে। থাকবে সুন্দর একটি উদ্যান। দুই, তিন এবং চারতলা নির্ধারিত থাকবে বাসস্থান হিসেবে। নিচতলায় থাকবে লাইব্রেরি, লাউঞ্জ, বিলিয়ার্ড রুম, ব্যাংকুয়েট হল এবং ১০০ ফুট দীর্ঘ ভোজনাগার। এটি নির্মাণ করতে সরকারের আধা কোটি টাকা ব্যয় হবে। আশা করা যায়, আগামী বছর হোটেলটি উদ্বোধন করা হবে।

কলতাবাজারের হাফিজউদ্দিন কন্ট্রাক্টর

আজিম বখশ জানান, কলতাবাজারের হাফিজউদ্দিন কন্ট্রাক্টর ও তার ভাই আফসারউদ্দিন কন্ট্রাক্টর ভবনটির নির্মাণ কাজের দায়িত্বে ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় এত সুন্দর ভবন আর ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ব্যবসায়ী এবং এমএনএ-রা সবাই এ হোটেলেই থাকতেন। এখানে থাকার সুবিধা ছিল ভালো, খাবারও ছিল মানসম্পন্ন।

১৯৬৮ সালে হোটেল শাহবাগের রেটকার্ড। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার আরও দু’জন পুরান বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়। তারা হলেন টুটু সাদ এবং লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী।

টুটু সাদের বয়স আশির বেশি। ১৯৫০-এর দশক থেকে সেগুনবাগিচায় তাদের বসতি। বাড়ি থেকে হোটেলের দূরত্ব ছিল অল্প। তাই প্রায়ই পরিবারের সঙ্গে যেতেন শাহবাগ হোটেলে। ১৯৫৫-৫৬ সালে বয়স তার ১১ বা ১২ হবে। হোটেল শাহবাগের খাবারের কথা তার বেশি মনে পড়ে।

তিনি বলেন, ‘হোটেলের নিচ তলাতেই খাবার পরিবেশন হতো। তখনকার ঢাকায় আন্তর্জাতিক মানের খাবার পাওয়া যেতো কেবল ওখানেই। একটা কাবাব আইটেম ছিল। বলতে গেলে ওটা ছিল ঢাকার ওয়ান অব দ্য বেস্ট কাবাব। আমার এখনো সে কাবাবের স্বাদ মনে আছে।’

আফসান চৌধুরীও ভক্ত ছিলেন হোটেল শাহবাগের খাবারের। তিনি বলেন, ‘প্রায় সময় বাবা ওখান থেকে খাবার নিয়ে আসতেন। আমার বিশেষভাবে মনে আছে পুডিংয়ের কথা। বেশ ভালো পুডিং ছিল ওটা। ক্রিসমাস বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দিনে কেক দিতো। সেটাও বেশ মজার ছিল খেতে।’

সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ২৫ রুপি

১৯৬৮ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত হোটেলের রেট চার্ট থেকে জানা যায়, একক ঘরের ভাড়া ২৫ রুপি, ডাবল রুম ৪০ রুপি। ঘরে টেলিফোন নিতে চাইলে বাড়তি গুনতে হবে ২ রুপি, এয়ারকন্ডিশনসমেত ঘর চাইলে আরও ১০ রুপি বাড়তি পড়বে। হোটেলের ডাক ও টেলিগ্রাফ অফিস, কিউরিও শপ, মেডিক্যাল স্টোর ছিল হাতের নাগালে।

খাবারের মধ্যে কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট মিলত আড়াই রুপিতে, দুপুরের খাবার সাড়ে চার টাকায়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বারে মিলত স্পিরিট, ওয়াইন আর লিকার। হোটেল চন্দ্রিমায় খোলা আকাশের নীচে হতো বারবিকিউ।

ষাটের দশকে হোটেল শাহবাগ। ছবি: সংগৃহীত

এ চন্দ্রিমা হোটেলের কাবাব-পরটা খুব ভালো ছিল বলে জানালেন আজিম বখশ। কয়েকবার তিনি এর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। চাঁদের আলো গায়ে মেখে কাবাব খাওয়ার স্মৃতি তার আজও তাজা। বখশ আরও জানালেন, হোটেল শাহবাগে কুল নামে অরেঞ্জ ফ্লেভারড একটি সফট ড্রিংকস পাওয়া যেত কাচের বোতলে যা বাইরের লোকেও কিনে বাড়ি নিয়ে যেতে পারতেন। পরে কাচের বোতল ফেরত দিয়ে গেলে বাড়তি টাকা ফেরত পেত।

আজিম বখশের আরও মনে আছে, ইংল্যান্ডের হিলম্যান কার কোম্পানি এখানে একবার একটি মোটর শোয়ের আয়োজন করেছিল।

আফসান চৌধুরীর ভাইয়ের বিয়ে

তাছাড়া শহরের বনেদি পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানও আয়োজিত হতো এখানে। আফসান চৌধুরীর নিজের বড় ভাইয়েরও বিয়ে হয়েছিল ওই হোটেলে। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন টিকাটুলী থেকে দিলুরোডে চলে যাই তখনো এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় হোটেল। আমার বাবা সে সময়ে ছিলেন পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা অফিসের মিটিংয়ের কাজে প্রায়ই যেতেন। ১৯৬৮ সালে আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়। আমার বাবা তখন মোটামুটি ওপর তলার একজন মানুষ। ভালো টাকা পয়সা ছিল। তাই বড় ভাইয়ের বিয়ের রিসেপশনের অনুষ্ঠান হয় শাহবাগ হোটেলে।’

আজিম বখশ অবশ্য তেমন কোনো অনুষ্ঠানে নিজে যোগদান করেননি। তিনি চন্দ্রিমার খোলা লনে অনেক শুটিং হতে দেখেছেন। নায়ক-নায়িকা বা ছবির নাম অবশ্য তার মনে নেই এখন।

হোসাইন মোহাম্মদ জাকির লেখা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর মহরৎ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ হোটেলে। হলিউডের ছবি ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’-এর কিছু অংশ ১৯৫৫ সালে চিত্রায়িত হয়েছিল শ্রীমঙ্গলে। তার পুরো ইউনিটের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল হোটেলটিতে।

পাল্টাপাল্টি মুশায়রা

কবিতা পাঠের আসরও হতো এ হোটেলে। কবি নির্মলেন্দু গুণের আত্মজীবনী ‘আমার কণ্ঠস্বর’ থেকে জাকী জানতে পেরেছেন, ১৯৬৮ সালের ৩১ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মুশায়েরার জমজমাট আয়োজন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের লেখকদের অধিকাংশই অনুষ্ঠানটির খবর জানতেন না। ফলে এ অঞ্চলের লেখক সংঘের উদ্যোগে একই বছরের ১৯ মে পাল্টাপাল্টি এক কবিতা সন্ধ্যার আয়োজন করা হয় হোটেল শাহবাগের ব্যাংকুয়েট হলে যার উদ্যোক্তা ছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান।

‘মিলন’ ছবিতে রহমান ও দীবা, যারা চিত্রায়ন হয়েছিল হোটেল শাহবাগে। ছবি: সংগৃহীত

আজিম বখশের মনে আছে হোটেলের প্রবেশ মুখ ছিল পূবালী ব্যাংকের দিক দিয়ে আর বেরোবার ফটক ছিল বারডেমের দিক দিয়ে। হোটেলের অভ্যর্থনা বা রিসেপশনটি ছিল আকর্ষণীয়। ওপর থেকে ঝাড়বাতি ঝুলত, শেকলে বাঁধা ছিল ঘণ্টাও। হোটেলের খাবার পরিবেশনকারীরা সাদা আচকান ও পাজামা পরতেন, কোমরের দিকে বেশ চওড়া সোনালী অথবা লাল রঙের কাপড় বাঁধা থাকত। তাদেরকে বলা হতো বাটলার।

টুটু সাদের অবশ্য মনে আছে আরেকটু বেশি। তিনি জানিয়েছেন, হোটেলের যারা বেয়ারা ছিলেন, তাদের মাথায় থাকত সাদা রঙের পাগড়ি। পরনে ডাবল ব্রেস্টেড কোট, জামায় সোনালি রঙের বোতাম লাগানো থাকত। হাতে সাদা দস্তানা জড়িয়ে খাবার পরিবেশন করতেন তারা।

হোটেলের রুমগুলো বড় আর পরিপাটি ছিল। গবেষক রেজাউল করিম মুকুল লিখেছেন, শাহবাগ হোটেলের ভেতরে লম্বা বারান্দা দিয়ে পাকিস্তানের মোনালিসা খ্যাত নায়িকা দিবা একটা লম্বা দৌড় দিয়েছিলেন ‘মিলন’ ছবির দৃশ্যায়নের প্রয়োজনে। তখন নায়ক রহমান গাইছিলেন, ‘তুম ছালামত রহ, মুসকুরা ওহাসো, মায় তোমহারা লিয়ে গীত গা তা রাহা হু।’

তিন কালে তিন হাল

হোটেলটি অবশ্য বেশিদিন আয়ু পায়নি। তবে ষোল-সতের বছরে কম ইতিহাস তৈরি করেনি। তার অনেকটাই অনেকে মনের কুঠুরিতে বন্দি করে করাচি, ইস্পাহান, নিউ ইয়র্ক বা সিডনিতে নিয়ে গেছেন। যারা যাননি তারা আর ঘেঁটে কী হবে ভেবে সময় শেষ করে ফেলেছেন। 

খুবই মজার ব্যাপার হলো এ ভবনটি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তিন আমলেই বিভিন্নভাবে কার্যকর থেকেছে। ব্রিটিশ আমলে ছিল নাচঘর, তারপর হলো হোটেল আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয়; বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রধানতম বিদ্যাপীঠ। আইপিজিএমআর বলে এর শুরু, এখনো অনেকেই একে পিজি হাসপাতাল বলে ভালো চেনেন। যদিও কেতাবি নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

হাসপাতালের যে প্রশাসনিক ভবন সেটিই ছিল হোটেল। দোতলায় যেখানে উপাচার্য বসেন তার নীচেই ছিল বার। টুটু সাদের বর্ণনায়ও উঠে আসে বারের কথা। তিনি জানান, ‘বারের পাশেই ছিল কাঠ দিয়ে তৈরি একটি উঁচু ডান্স ফ্লোর। সেখানে সমর দাস [বিখ্যাত বাংলাদেশি সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক] পিয়ানো বাজাতেন। বিশেষ কোনো প্রোগ্রাম বা বিশেষ কেউ এলে কেবল নাচের অনুষ্ঠান হতো। নাচ বলতে মূলত বেলি ডান্স হতো।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিজি হাসপাতাল) বর্তমানের এ প্রশাসনিক ভবনটিই ছিলে হোটেল শাহবাগ। ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা

সে যা-ই হোক। জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম আইপিজিএমআর-এর সূচনাকালে ছিলেন যুগ্ম পরিচালক। তিনি ‘হিস্ট্রি অব আইপিজিএমআর’ নামে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থ লিখে গেছেন, যাতে ইনস্টিটিউটির প্রতিষ্ঠাকাল, শৈশব ও যৌবনবেলার সব ঘটনা বলা আছে। সে ইতিহাসও জানার পক্ষে ভালো তবে তা অন্য কোনো লেখায়। আজকে কেবল হোটেল থেকে হাসপাতালে রুপান্তরের হওয়ার অংশই বলা যাক।

পিজির যাত্রা শুরু

১৯৬১ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে প্রথম পোস্টগ্রাজুয়েট চিকিৎসা শিক্ষা বিষয়ক প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। তারও তিন বছর পরে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যসেবা দপ্তর প্রাদেশিক পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের নিকট ঢাকা মেডিকেল কলেজে পোস্ট গ্রাজুয়েট সেন্টার প্রতিষ্ঠার কথা বিধিবদ্ধভাবে উপস্থাপন করে। ১৯৬৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কয়েকজন সিনিয়র অধ্যাপককে সদস্য করে একটি অ্যাড-হক কমিটি গঠিত হয়।

ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের এক অনানুষ্ঠানিক সভায় পরের বছর জানুয়ারি থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষারম্ভের পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং ছাত্রদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রথম ব্যাচে ৩৩ জন ছাত্র শিক্ষাগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হন। প্রথম ব্যাচের পাঠকার্য শুরু হয়ে গেলেও ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েটের কোনো নিজস্ব স্থাপনা ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুম ধার নিয়ে শিক্ষাগ্রহণ চলতে থাকে। আরও পরের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো আর্টস বিল্ডিং এবং কমার্স ব্লকও আইপিজিএমআর-এর শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের কাজে ব্যবহৃত হয়।

ধীরগতিতে হলেও ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম মন্দ চলছিল না। কিন্তু ১৯৬৮ সালে বেঁকে বসল পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। তারা বলল যেহেতু একই ধরনের ইনস্টিটিউট করাচিতেও একটি আছে, তাই প্রাদেশিক রাজধানীতে আরেকটি থাকার দরকার নেই। তখন নূরুল ইসলামকে লিখে পাঠাতে হলো, একই দেশের দুটি প্রদেশের মধ্যে হাজার মাইল ব্যবধান থাকলে আরেকটি ইনস্টিটিউট প্রাদেশিক রাজধানীতে থাকা অনিবার্য হয়ে ওঠে।

এ প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার বলে পাঠাল, ঠিক আছে তোমরা নিজেরা যদি চালাতে পারও আমার ‘বাধা দিব না’, তবে আমাদের কাছ থেকে কোনো অর্থ সহায়তা আশা কোরো না। তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন ও চিকিৎসক, শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রচেষ্টাতেই কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। তারপর দেশে শুরু হলো যুদ্ধ, মুক্তির যুদ্ধ।

হোটেল শাহবাগে কোনো একটি আনন্দঘন অনুষ্ঠান। ছবি: সংগৃহীত

হোটেল থেকে হাসপাতাল

বিজয় অর্জনের পর সরকার শাহবাগ হোটেলকে আইপিজিএমআর-এর স্থায়ী ঠিকানা করার সম্ভাবনা যাচাই করতে ডা. নূরুল ইসলামসহ তিনজনের একটি কমিটি করল। এর আগের কয়েক বছর ধরেই হোটেলটি ধুঁকছিল, বলা ভালো লোকসান গুনছিল। ভেতরের আসবাব ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রও ভালো ছিল না।

প্রকৌশলীদের সহায়তা নিয়ে কমিটি হোটেলটিকে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করে এবং একে হাসপাতালে রূপান্তর সম্ভব বলে স্থির করে। তারপর তা সরকারকে জানানোর পর ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রথম যা করা হয় তা হলো বার হলটিকে মেডিক্যাল ওয়ার্ডে রূপান্তর করা হয়। তারপর বড় ডাইনিং হলটিকে লাইব্রেরি, টি রুমকে কনফারেন্স রুমে রূপান্তরিত করা হয়।

এরপর বড় ডাইনিং হল লাগোয় ছোট হলটিকে রেডিওলজি ডিপার্টমেন্টের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। নার্সদের জন্য টপ ফ্লোর বরাদ্দ করা হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কেবিন বানানো হয়। খালি জায়গাগুলোর কোনোটায় বসে পেয়িং ওয়ার্ড, কোনোটা নন পেয়িং। নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত করে সিনিয়র শিক্ষকদের রুম বরাদ্দ করা হয়।

‘তুম ছালামত রহ’

স্বাধীন দেশের প্রথম স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরী সামনের পূবালী ব্যাংক ভবন, যেখানে মুসলিম লীগের অফিস ছিল, সেটিকেও আইপিজিএমআর-এর সঙ্গে যুক্ত করেন। এরপর থেকে দিনে দিনে গবেষণা, ডিপার্টমেন্ট ও ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭৪ সালে হয় প্রথম রিইউনিয়ন।

১৯৭৫ সালে রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অব এডিনবরার স্যার জন ক্রফটন আইপিজিএমআর ভিজিট করে কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করেন। বলে রাখা দরকার, রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানসের ডা. জেমস ক্যামেরন ছিলেন আইপিজিএমআর-এর প্রথম পরিচালক।

১৯৭৬ সালে নতুন ইএনটি (কান, নাক, ও গলা) ব্লক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭৭ সালে হয় তৃতীয় রিইউনিয়ন ও বার্ষিক সায়েন্টিফিক সেমিনার। প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি, তবে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে; বিশেষ করে জায়গা-জমির জন্য। ১৯৬৮ সালে ক্যামেরন চলে যাওয়ার পর ডা. নূরুল ইসলামকে পরিচালকের দায়িত্ব নিতে হয়। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল থাকেন।

১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। হাসপাতালটিতে সারাদেশ থেকে লোক আসে প্রতিদিন। সবাই ব্যস্ত থাকে রোগবালাই নিয়ে, শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও সেমিনার নিয়ে। ইশরাত মঞ্জিল তো মুছেই গেছে, কিন্তু হোটেলটির কাঠামো তো বর্তমান। এটুকুও কম নয়।

তাই নায়ক রহমানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘তুম ছালামত রহ, মুসকুরা ওহাসো। ম্যায় তোমহারে লিয়ে গীত গা তা রাহা হু।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacantoto4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d toto
slot toto
bacan4d
bacan4d
togel online
Toto Slot
saraslot88
Bacan4d Login
bacantoto
Bacan4d Login
bacan4d
bacan4drtp
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot maxwin
slot bacan4d
slot maxwin
bacan4d togel
bacan4d login
bacan4d login
bacan4d login
bacantoto 4d
slot gacor
bacansport
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot77 gacor
JAVHD
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
gacor slot
slot gacor777
slot gacor bacan4d
bacan4d
bacansport
toto gacor
bacan4d
bacansports login
slot maxwin
slot dana
slot gacor
slot dana
slot gacor
bacansports
bacansport
bacansport
bacansport
bawan4d
bacansports
bacansport
slot gacor
judi bola
slot maxwin
slot maxwin
bacansport
bacan4d
bacansport
slot gacor
slot demo
slot gacor
slot gacor
slot gacor
toto slot
slot gacor
demo slot gacor
slot maxwin
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacansport
slot gacor
slot toto