USA

হোয়াইট হাউস কি ট্রাম্প ও মাস্কের ভার বইতে পারবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী সপ্তাহে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এক অর্থে, সেদিন পবিত্র বাইবেলে হাত রাখবেন ধনকুবের ইলন মাস্কও। আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন সম্পর্ক। ট্রাম্প এমন একজন উপদেষ্টার ছায়া নিয়ে হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন যিনি শুধু বিশ্বের শীর্ষ ধনীই নন; উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কট্টর ডানপন্থী রাজনীতি, গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব রাখাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের (ট্রাম্প) সঙ্গে মিল রয়েছে তাঁর।

এত মিল সত্ত্বেও বিরাট প্রভাবশালী এ দুই ব্যক্তির জন্য ওভাল অফিস কি যথেষ্ট বড় হবে? শুধু মাস্ককে নিয়ে যে পাহাড়সম স্বার্থের সংঘাতে ট্রাম্প জড়াতে পারেন, তারই–বা কী হবে? উঠেছে এমন প্রশ্ন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচার–প্রচারণায় মাস্কের অর্থায়নের মধ্য দিয়ে দুজনের মধ্যে রাজনৈতিক দহরম-মহরমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটেছে দুজনের মধ্যে মিল রয়েছে, এমন অনেক বিষয়ে।

বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে এ জুটির ক্ষমতা অসাধারণ। মাস্ক তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সকে ডানপন্থীদের জন্য একটি আশ্রয়স্থলে পরিণত করেছেন। রক্ষণশীল গণমাধ্যমগুলো ট্রাম্পের প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করে। ট্রাম্প ও মাস্ক দুজনই উসকানিমূলক নাটকীয়তা প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মার্গারেট ও’মারা মনে করেন, ট্রাম্পের মতো মাস্কও কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তিনি এমন কিছু কথাবার্তা বলেন ও কাজ করেন, যা কারও কারও কাছে আপত্তিকর মনে হয়। প্রচলিত রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে তিনি পছন্দ করেন।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক পিটার লোজের মতে, ‘একসময়ের ও ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টের (ট্রাম্প) ওপর মাস্ক বেশ প্রভাব ফেলেছেন।’

ইলন মাস্ককে ধনী ও সাহসী হিসেবে উল্লেখ করে লোজ আরও বলেন, মাস্ক ক্রমাগত ট্রাম্পকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি (ট্রাম্প) কতটা দুর্দান্ত। আর এসব ট্রাম্প পছন্দ করেন।

অবশ্য রোমের লুইস গিদো কার্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক লোরেঞ্জো কাস্টেলানি সতর্ক করে বলেন, লম্বা সময় কাজ করতে গেলে বিরোধ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় কমানো ও নিয়মনীতি–সংক্রান্ত পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব মাস্ককে দিয়েছেন ট্রাম্প। ডানপন্থী মতাদর্শীদের কাছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনাগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মাস্ক যেহেতু সরকারের বড় একজন চুক্তিকারী হিসেবে এখানে ভূমিকা রাখবেন, সে ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনার সময় সৃষ্ট স্বার্থের দ্বন্দ্বকে কীভাবে এড়ানো যাবে, ট্রাম্পশিবির তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।

২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ট্রাম্প। তাঁর শপথ নেওয়ার আগেই মাস্ককে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা গেছে।

টেসলা ও স্পেসএক্সের স্বত্বাধিকারী মাস্ক শুরুতেই ফেডারেল সরকারের ব্যয় ২ লাখ কোটি ডলার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা অসম্ভব। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, ‘আমাদের ১ লাখ কোটি ডলার সাশ্রয়ের একটি ভালো সুযোগ আছে।’

তবে এ পরিমাণ ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা কার্যকর করাও কঠিন। সরকারের প্রায় ৭ লাখ কোটি ডলারের সামগ্রিক বাজেট থেকে এ পরিমাণ ব্যয় কমাতে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা বা সুবিধায় কাটছাঁট করতে হবে।

গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় থেকে প্রায় সব সময়ই মাস্ককে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা গেছে।

ট্রাম্পের এক নির্বাচনী সভায় টেসলার সিইও ইলন মাস্ক। ৫ অক্টোবর ২০২৪, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্পের এক নির্বাচনী সভায় টেসলার সিইও ইলন মাস্ক। ৫ অক্টোবর ২০২৪, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

ব্যবসায়ী নেতা ও বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে ট্রাম্পের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে মাস্ক উপস্থিত ছিলেন। ছবিতে দুজনকে প্রায়ই একসঙ্গে খেতে দেখা যায়। এমনকি খ্রিষ্টীয় নববর্ষের আগের দিন সন্ধ্যায় ‘ওয়াইএমসিএ’-এর অনুষ্ঠানে একসঙ্গে নাচতে দেখা গিয়েছিল তাঁদের।

অধ্যাপক কাস্টেলানির মতে, ট্রাম্পের সঙ্গে মাস্কের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ‘রবার ব্যারনস’ নামে পরিচিত প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে ছিলেন-কর্নেলিয়াস ভান্ডারবিল্ট, অ্যান্ড্রু কার্নেগি ও জেপি মরগ্যান। তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে যেমন অনেক ক্ষমতাধর ছিলেন, তেমন রাজনৈতিকভাবেও তাঁদের ছিল ব্যাপক প্রভাব।

মাস্ক তাঁর এই পূর্বসূরিদের মতো করেই নিজের স্বার্থ রক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটাচ্ছেন। ডানপন্থী আন্দোলন জোরদার ও ইউরোপে অনলাইন লড়াই শুরু করতে তিনি তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সকে ব্যবহার করেছেন।

যুক্তরাজ্যে আইনপ্রণেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করায় মাস্ক কঠোরভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে আক্রমণ করেছেন। তাঁর পদত্যাগও দাবি করেছেন তিনি।

মাস্ক বারবারই জার্মানির কট্টর ডানপন্থী দল এএফডির প্রশংসা করেছেন। তবে এক্সকে ব্রাসেলস মোটা অঙ্কের জরিমানা করার হুমকি দেওয়ায় ইউরোপীয় কমিশনের সমালোচনা করেছেন। অন্য ব্যবসায়ীরাও ট্রাম্পের বলয়ে ভিড় জমাচ্ছেন। সরকারের আকার ছোট রাখাসহ মাস্কের উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিগুলো তাঁদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

কিন্তু মার্কিন অভিজাতদের উত্থানকে কেন্দ্র করে ডানপন্থীদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। কারণ, তাঁদের আশা ছিল, ট্রাম্প বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগান বাস্তবায়িত করবেন। অথচ ক্ষমতায় আসীন হতে যাওয়া এসব ধনীকে সেই বিশ্বায়নেরই প্রতীক বলে বিবেচনা করছেন তাঁরা।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর নতুন বিভাগ ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’র প্রধান হিসেবে মাস্ক কাজ করবেন বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। একই বিভাগে মাস্কের সঙ্গে আরও একজন প্রধান থাকবেন। তিনি হলেন সিলিকন ভ্যালির ব্যবসায়ী বিবেক রামাস্বামী।

ভারতীয় অভিবাসীর সন্তান রামাস্বামী একটি ভিসা কর্মসূচির পক্ষ নিয়ে কথা বলার পর ব্যাপক ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। ওই কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত দক্ষ কর্মীদের আসার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে সেরার চেয়ে মাঝারি মানকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার সংস্কৃতি চলে আসছে উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছিলেন রামাস্বামী।

মাস্ক, রামাস্বামীর মতো ব্যক্তিদের মনোনয়ন ট্রাম্পের পুরোনো সমর্থকেরা ভালোভাবে নেননি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button