Bangladesh

১০ কোটি ডিম কি কোনো পার্থক্য তৈরি করবে?

টাইগার ট্রেডিং লিমিটেড-এর স্বত্বাধিকারী সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমরা ভারত থেকে আমদানির পর স্থানীয় বাজারে প্রতিটি ডিম আনুমানিক নয় থেকে ১০ টাকায় বিক্রির আশা করছি। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি ডিম আমদানির খরচ পড়বে ৫ টাকা ৯০ পয়সা থেকে সাত টাকা ২০ পয়সা।’

১০ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার, দেশের বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে যা সুখবরই। তবে দেশের মানুষের বড়জোর আড়াই দিনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম এ পরিমাণ ডিম দিয়ে বাজারের আগুন হয়তো নেভানো যাবে না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৭ সেপ্টেম্বর চারটি কোম্পানিকে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল আরও ছয়টি কোম্পানিকে ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।

ব্যবসায়ীরা সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্য মেনে না চলায় ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

সরকার ডিম প্রতি ১২ টাকা খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও ঢাকায় ডিম বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১২ টাকা বা তারও বেশি দামে।

উচ্চমূল্যের প্রোটিন-উৎস মাছ এবং মাংসের সহজলভ্য বিকল্প হচ্ছে ডিম। কম আয়ের মানুষ সকালের নাস্তা অথবা দুপুরের খাবারের জন্য ডিমকেই বেছে নিতেন এতদিন। তাই ব্যবসায়ীদের ডিম বিক্রিও চলছিল জমজমাট। কিন্তু সম্প্রতি ডিমের দাম হু-হু করে বেড়ে বেশিরভাগের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

এ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ডিমের উৎপাদন ২৫ শতাংশ পতনের মাঝে এ উচ্চ চাহিদা ডিমের দামকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

যদিও তারা এ মুহূর্তে ডিম আমদানিতে কোনো সমস্যা দেখছেন না, তবে আমদানি অব্যাহত থাকলে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা চান পোল্ট্রি খামারিদের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সমাধান করতে।

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশ-এর সেক্রেটারি মো. মাহবুবুর রহমান ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। এতে করে ডিম উৎপাদনকারীদের কোনো ভুল থাকলে তা শোধরানোর সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি।

তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় খাতকে স্থিতিশীল করতে হলে দরকার সঠিক পরিকল্পনা। প্রকৃত চাহিদা এবং বর্তমান উৎপাদনের মাত্রার সঠিক ধারণা কি আমাদের আছে?’

মাহবুবুর রহমান নিজ নিজ প্রয়োজনের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট জেলা বা উপজেলায় ডিম উৎপাদনের কৌশল প্রণয়নে সরকারি হস্তক্ষেপের গুরুত্বের ওপর দৃঢ়ভাবে জোর দিয়েছেন।

এদিকে পোল্ট্রি খামারিরাও পোল্ট্রি ফিডের ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা সরকারকে ডিমের মতো করে ফিডের দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

আমদানি কি বাজার স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে?

প্রান্তিক খামারিরা জানান, খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে দেশীয় ডিম উৎপাদন দৈনিক আনুমানিক তিন কোটি ৭৫ লাখ পিস কমে গিয়েছে। ফলে চাহিদার তুলনায় ২৫ লাখ ডিম কম উৎপাদন হচ্ছে।

সুতরাং, যদি দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ লাখ আমদানি করা ডিম দেশের বাজারে প্রবেশ করে, তাহলে ১০ কোটি ডিমের ধারাবাহিক আমদানি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাজারের ঘাটতি ও দাম কমাতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে এক কোটি করে ডিম আমদানির অনুমতি পাওয়া চারটি কোম্পানি দ্রুত আমদানির জন্য প্রথমে ভারত থেকে ডিম আনার পরিকল্পনা করেছে।

তারা আগামী সপ্তাহের মধ্যে এসব ডিম দেশের বাজারে ছাড়তে চায়।

চারটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের একটি টাইগার ট্রেডিং লিমিটেড-এর স্বত্বাধিকারী সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমরা ভারত থেকে আমদানির পর স্থানীয় বাজারে প্রতিটি ডিম আনুমানিক নয় থেকে ১০ টাকায় বিক্রির আশা করছি। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি ডিম আমদানির খরচ পড়বে ৫ টাকা ৯০ পয়সা থেকে সাত টাকা ২০ পয়সা।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ভারতীয় ডিম আকারে ছোট, যা দেখলেই আলাদা করা যাবে। সুতরাং এগুলো চাইলেও সহজে ভোক্তার কাছে বেশি দামে বিক্রি করা যাবে না। পাশাপাশি আমাদের মনিটরিং তো থাকছেই।’

আমদানি ডিমের বাজার স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

কী কারণে ডিমের দাম বেড়েছে?

করোনা-পরবর্তী সময়ে লোকসানে পড়া, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ফিডের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুতের দাম বাড়া পোল্ট্রি খাতের উৎপাদনে বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন পোল্ট্রি খামারিরা। লোকসানের কারণে অনেক খামারিই উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান তারা।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের এক লাখ ৫৮ হাজার ১৭টি খামারের মধ্যে বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে ৯৫ হাজার ৫২৩টি।

অ্যাসোসিয়েশন-এর মার্চের তথ্য বলছে, খামার বন্ধ হওয়ার কারণে দেশে দৈনিক ছয় কোটি ৬৪ লাখ ডিম উৎপাদনের সক্ষমতা কমে চার কোটি ৩২ লাখে নেমেছে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) জানিয়েছে, আগস্ট মাসে ডিমের উৎপাদন পৌনে চার কোটি পিসে নেমে এসেছিল। অন্যদিকে মাছ ও সবজির দাম বৃদ্ধির কারণে ডিমের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল।

ফলে জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে ডিমের দাম বাড়তে শুরু করে যা আগস্টে এসে ডিমপ্রতি ১৫ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়।

তবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার মনিটরিং এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন খরচ প্রকাশের পর প্রতিটি ডিমের দাম ধীরে ধীরে কমে সাড়ে ১২ টাকা হয়।

পোল্ট্রি খাতে ডিম আমদানির সম্ভাব্য প্রভাব

মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদনকারীরা জানান, ডিমের আমদানিতে এ খাতে বড় প্রভাব পড়বে, কারণ এ শিল্পে অনেক ছোট, মাঝারি ও বড় খামারি রয়েছেন।

তারা বলছেন, এর মাধ্যমে আমদানি ও উৎপাদনের মধ্যে কোনটি উপযুক্ত তা স্পষ্ট হবে এবং তারপরে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কোনটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রান্তিক পর্যায়ে ডিম উৎপাদনে খরচ হয় ১০ টাকা ৮০ পয়সা এবং কর্পোরেট পর্যায়ে সাড়ে ১০ টাকা। তাই ১০ টাকায় ডিম বিক্রি হলে উভয় উৎপাদনকারীরই লোকসান হবে।

তাই উৎপাদনকারীদের দাবি ছিল খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিম সাড়ে ১২ টাকা হলে তা ভোক্তা ও উৎপাদকদের জন্য যৌক্তিক হতো।

ফিডের দামও নিয়ন্ত্রণের আহ্বান

ডিম উৎপাদনকারীরা বলছেন, পোল্ট্রি ফিডের দামও একটি সমস্যা। ভুট্টা এবং সয়াবিন মিল পোল্ট্রি ফিডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান উল্লেখ করে তাদের পরামর্শ, হয় ভারতের মতো বিকল্প তৈরি করা দরকার, অথবা সরকারকে এ দুটির দাম কম রাখার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিপিআইসিসি সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, মাছ, মাংস ও সবজির দাম বাড়ার কারণে ডিমের চাহিদা বাড়লেও দীর্ঘদিন লোকসান গুনে অনেক খামারিই ডিম উৎপাদন থেকে সরে এসেছেন। তাই প্রকৃত চাহিদা নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী উৎপাদন পরিকল্পনা তৈরি করা জরুরি।

ফিডের দাম কমাতে সরকারকে বিনা শুল্কে ভারত থেকে কিছু বিকল্প ফিড উপাদান আমদানির অনুমতি দেওয়ারও সুপারিশ করেন তিনি।

২০২০ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি–মার্চে ব্রয়লার ফিডের দাম ৫১ শতাংশ এবং লেয়ার ফিডের (ডিম উৎপাদনে ব্যবহৃত) দাম ৫৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেড়েছে। ফলে গড় উৎপাদন খরচ ১২০ থেকে ১৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ডিমের দাম উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত যেভাবে নির্ধারণ করা হয়, সেভাবে ফিডের দাম নির্ধারণ করলে ডিম উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও দাবি খামারিদের।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)-এর প্রাক্তন মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকার বলেন, বিশ্বব্যাপী পোল্ট্রি উৎপাদন ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে।

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশেও ছোট ও মাঝারি আকারের কৃষকদের মধ্যে উৎপাদন উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গবাদি পশু উৎপাদন খরচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খাদ্য। ভারত এ ক্ষেত্রে স্বনির্ভর, তারা কম খরচে এটি উৎপাদন করতে পারে। তবে আমরা প্রয়োজনীয় ভুট্টার মাত্র ৬০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করি। বাকিটা আমদানি করতে হয়।’

তিনি বৃহৎ পোল্ট্রি শিল্পের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button