১০.২২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে খাদ্যে, শহরের চেয়ে বেশি গ্রামে
একমাসের ব্যবধানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার বেড়েছে। সবশেষ গত এপ্রিল মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে উঠেছে। এর আগের মাস মার্চে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তার সঙ্গে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্য-বহির্ভূত খাতেও খরচ বেড়েছে।
সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বেশি চাপে আছে। একইসঙ্গে যে হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সেভাবে মানুষের আয় বাড়েনি। গ্রামে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২, যেখানে শহরাঞ্চলের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৬। গ্রাম ও শহর দুই অঞ্চলেই খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আবার দুই অঙ্ক ছাড়িয়েছে। সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
যদিও সরকারের নথিপত্রে আগামী তিন অর্থবছরের (২০২৪-২৫, ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭) মূল্যস্ফীতির গড় লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশের ওপরে উঠবে না-এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, নথিপত্রে প্রাক্কলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু বাস্তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে উঠেছে বলে সম্প্রতি বিআইডিএস’র এক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে।
সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে খাদ্য-বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে; গত মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর আগে মার্চ মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এদিকে, গত এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ হয়েছে; আগের মাস মার্চে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।
বিবিএস প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এপ্রিলে শহরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ, অথচ গ্রামে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গ্রামে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং খাদ্য-বহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। অন্যদিকে, শহরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। শহরে খাদ্য খাতে ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং খাদ্য-বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৯ দশমিক ০১ শতাংশ।
শহরের তুলনায় গ্রামে সব খাতেই মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। বিবিএস বলছে, যেখানে এপ্রিল মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, সেখানে মজুরি সূচক বেড়ে মাত্র ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ হয়েছে। তার মানে সংসারের খরচ মেটাতে ধারদেনা করতে হচ্ছে। কৃষিতে ৮ দশমিক ২৫, শিল্প খাতে ৭ দশমিক ৩৬ ও সেবা খাতে মজুরি সূচক ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। কোনো খাতেই ৯ শতাংশের ওপরে মজুরি নেই, অথচ সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য পর্যালোচনা ও নিজেদের উদ্যোগে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে গরিব মানুষের ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। এরপর রয়েছে পোল্ট্রি পণ্য-মুরগির মাংস ও ডিম।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর চেয়ারম্যান সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে সমন্বিত ও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ায় তা বাড়ছে।
এটা মূল্যস্ফীতি কমাতে ভূমিকা রাখবে, তবে তা সময়সাপেক্ষ। একদিকে সুদের হার যদি বাড়ে, আরেকদিকে মার্কিন ডলারের দামও বাড়তে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। কারণ, ডলারের দাম বাড়লে পণ্য ও কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বাড়ে।
সূত্র মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। বিশ্ববাজারে পণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও মূল্যহ্রাসের কারণে অনেক দেশে পর্যায়ক্রমে নেমে আসে।
সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি উল্টো আরও বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশে নেওয়া হয়। যদিও বিবিএসের হিসাবে এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এদিকে সরকারের ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’ বৈঠকে আগামী তিন অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রার অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি আগামী বাজেটে ঘোষণা দেওয়া হবে। এর বাইরে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৬ শতাংশ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরের ক্ষেত্রে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু যা করলে সেটি কমবে, সেভাবে নীতি গ্রহণ করলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে। ফিসক্যাল পলিসিতে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কী পরিবর্তন হবে, বাজেট ঘাটতি কমানোর কী উদ্যোগ থাকছে সেটি বলতে হবে। এ ছাড়া টাকা ছাপিয়ে অর্থায়ন এবং ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ বন্ড ইস্যু করে টাকা না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে বুঝতে সুবিধা হবে যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে সেদিকে যাবে কি না। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দেখতে হবে সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা রূপরেখার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। আমাদের মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে আংশিক আন্তর্জাতিক মূল্য ও আংশিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর।
গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, ওই সময় দেশেও বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কমলেও আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেই দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে সেটি ধরে নেওয়া যায় না। এখন কতটা পণ্য আমদানি করতে পারছি, ডলারের মজুত কেমন, ঘাটতি বাজেটের জন্য কতটা টাকা ছাপানো হচ্ছে, মুদ্রানীতি সংকোচন না সম্প্রসারণ দেওয়া হচ্ছে, রাজস্বনীতি এসবের ওপর নির্ভর করছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থ বিভাগের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯-২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরে প্রতি মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে বিরাজ করে। কোভিড মহামারির পর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়।
এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে এর প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপর। সেখানে আরও বলা হয়, এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। ২০২২ সালে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
আইএমএফের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসছে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ থাকলেও ২০২৪ সালে প্রাক্কলন করেছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ।
এদিকে আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন অর্থ সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেছেন, খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য কমে আসায় ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। এ ছাড়া সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্র সাধন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। এ ছাড়া পণ্যের বাজার মনিটরিং, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি করা এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলবে।
পাশাপাশি ভোক্তার চাহিদা হ্রাসের লক্ষ্যে নীতি সুদ হার বাড়ানো ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণের কারণে ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ এবং ২০২৫ সালে আরও কমে আসবে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে সুদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯ শতাংশ সুদ হারের ক্যাপ তুলে নেওয়া হয়। এ উদ্যোগের ফলে ব্যাংকের তারল্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে।
এর ফলে বাজারে ভোক্তার চাহিদা হ্রাস পাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। তিনি আরও বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির আওতায় সরকারের উন্নয়ন খাতে ঋণ বন্ধ রেখেছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করছে।
এসব পদক্ষেপের ফলে আগামীতে মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক কারণগুলোকে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে মোকাবিলা সম্ভব। কিন্তু অ-অর্থনৈতিক (রাজস্ব ও মুদ্রানীতি বহির্ভূত) কারণগুলো মোকাবিলা সম্ভব নয়। এজন্য অ-অর্থনৈতিক কারণগুলো মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।