১৫ বছরে মোট ঘুষের পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ২২৫ কোটি
- সবচেয়ে বেশি পাসপোর্টে দুর্নীতি ৮৬ শতাংশ
- সেবা খাতের বিআরটিএতে দুর্নীতি হয়েছে ৮৫.২ শতাংশ
- সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারীর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৫৮.৩ শতাংশ
- সার্বিকভাবে ৭০.৯ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার
দেশের সেবা খাতের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে গেল বছর মানুষকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। তার পরেই অবস্থান রয়েছে বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়, বিচারিক সেবা ও ভূমি খাত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে উঠে এসেছে এ তথ্য। গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’ শীর্ষক ওই জরিপের ফল প্রকাশ করে সংস্থাটি। তাদের মোটা দাগে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা (হাউজহোল্ড) দুর্নীতির শিকার হয়েছে। জরিপে দুর্নীতির খাতভিত্তিক চিত্র উপস্থাপনের পাশাপাশি কিছু সুপারিশও করেছে টিআইবি।
টিআইবির জরিপের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই জরিপের মেয়াদকালে অন্যান্যসহ ১৮টি খাত বিবেচনায় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত পাঁচটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট (৮৬ শতাংশ), বিআরটিএ (৮৫ দশমিক ২ শতাংশ), আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ), বিচারিক সেবা (৬২ দশমিক ৩ শতাংশ) এবং ভূমি সেবা (৫১ দশমিক ০৭ শতাংশ)। জরিপে সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঘুষগ্রহণকারী পাঁচটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট (৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ), বিআরটিএ (৭১ দশমিক ৯ শতাংশ), আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ), বিচারিক সেবা (৩৪ দশমিক ১ শতাংশ), এবং ভূমি সেবা (৩২ দশমিক ৩ শতাংশ)।
জরিপে অন্তর্ভুক্ত ঘুষদাতা খানার ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’ এ কথা বলেছেন, অর্থাৎ ঘুষ আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অব্যাহত রয়েছে।
এ ছাড়া, ২০২৩ খানা জরিপে সার্বিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশের জিডিপির শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ। টিআইবির ২০১০ সাল থেকে পরিচালিত খানা জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ন্যূনতম প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে অন্তর্ভুক্ত খাত/প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে সেবা নিতে গিয়ে বাংলাদেশের খানাগুলো প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে।
টিআইবির এই জরিপে নির্বাচিত খানাগুলো ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সেবা গ্রহণে বিভিন্ন সেবা খাতে যেসব দুর্নীতি ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে, তার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
জরিপে আরও দেখা যায়, দরিদ্র, নিম্ন আয় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতি একটি অন্যায্য বোঝা। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর ঘুষ ও নিয়মবহির্ভূত অর্থের লেনদেনের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। যেসব খানার মাসিক আয় ২৪ হাজার টাকার কম, তাদের বার্ষিক আয়ের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ ঘুষ হিসেবে খরচ করতে হয়, পক্ষান্তরে মাসিক আয় ৮৫ হাজার টাকার বেশি এমন খানার ক্ষেত্রে এ হার শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ।
জরিপে আরও দেখা যায়, নারী, আদিবাসী এবং প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হওয়ার অর্থ তাদের সীমিত আর্থসামাজিক সক্ষমতার ওপর অতিরিক্ত বোঝা বিদ্যমান, যা তাদের প্রান্তিকতা আরও বৃদ্ধি করছে। পুরুষ সেবাগ্রহীতার তুলনায় নারী সেবাগ্রহীতাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি দুর্নীতির শিকার হওয়ার ফলে এসব খাতে নারীদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধের হাতিয়ারসমূহ বাংলাদেশে ব্যবহার হয় না উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা দেখে আসছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা বিষয়টি শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কাগজে কলমে সরকার দুর্নীতি রোধের কথা বললেও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা প্রতিবেদনগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়। যে প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর দুর্নীতি রোধের দায়িত্ব তাদের শুধু অকার্যকর নয়, বরং কর্মপরিধিও সীমিত করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি যে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে সাধারণ জনগণ জিম্মি হয়ে দুর্নীতিকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। দুর্নীতির দায়ে যারা অভিযুক্ত নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনে তাদের সভাপতি-প্রধান অতিথির আসনে বসানো হয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতির মর্যাদা দেওয়া হয়। এ ধারা অব্যাহত থাকা প্রমাণ করে যে, দুর্নীতিকে বিচারহীনতা প্রদানের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হচ্ছে, এ চিত্র আমাদের জন্য আশঙ্কাজনক। যারা দুর্নীতি করেন, তাদের অবশ্যই জবাবদিহি থেকে বোঝা যায়, একদিকে ডিজিটাল সেবা ত্রুটিপূর্ণ এবং অন্যদিকে ডিজিটালাইজেশন এমনভাবে করা হয়েছে যেন সেবাগ্রহীতা মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করতে এবং ঘুষ দিতে বাধ্য হয়, অর্থাৎ দুর্নীতি ও ঘুষের সুযোগ উন্মুক্ত থাকে।
তিনি বলেন, ‘সরকারি বিভিন্ন সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়া আংশিক ডিজিটালাইজেশনের কারণে সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সেবাগ্রহীতাদের মিশ্র পদ্ধতিতে সেবা নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, যার ফলে ঘুষ লেনদেনের সুযোগ বহাল রয়েছে। অনেকাংশে সেবাগ্রহীতাদের একাধিক পর্যায়ে ঘুষ দিতে হয়, কারণ অনেক কর্মকর্তা ঘুষ গ্রহণ করেও সেবা দেন না। সেবাগ্রহীতাদের যারা হয়রানি করে তাদের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদক অকার্যকর এটা সবাই জানেন। দুদকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন খুবই নগণ্য সংখ্যক মানুষ, মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। এর কারণ অভিযোগ দায়ের করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধিকাংশ নাগরিক ওয়াকিবহাল নন। অভিযোগ করেও প্রতিকার বা কোনো প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায় না, বরং অনেক সময় অভিযোগকারী হয়রানির শিকার হন। এভাবে জবাবদিহির অভাবে দুর্নীতি ব্যাপকতা ও গভীরতা সংকটময় পর্যায়েই রয়ে যাচ্ছে।’
জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য টিআইবি কিছু সুপারিশও করেছে। সুপারিশমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সেবা খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনানুগভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করা, এ ক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সক্রিয় ভূমিকা পালন; প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে সব সেবা পুরোপুরি ডিজিটাইজ করা, সব খাতের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস চালু করা এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা; জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেবাদানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেবাদাতার জন্য আচরণ বিধি প্রণয়ন ও কার্যকর করা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পেশাগত মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে পদোন্নতি, পদায়নের ব্যবস্থা, অন্যদিকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পদোন্নতি, পদায়ন ও পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করা। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানি ও সামাজিক নিরীক্ষার মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করা ইত্যাদি।