Hot

১৫ বছরে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার ৯৫ প্রকল্প, কর্তাদের পকেটে ৩০ ভাগ

জরাজীর্ণ রেললাইন-ব্রিজ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ সংস্কারে নেই কার্যকর প্রকল্প

রেলওয়ের উন্নয়নে গত ১৫ বছরে রীতিমতো প্রকল্প নেওয়ার হিড়িক পড়েছিল। নতুন নতুন প্রকল্প নিতেই বেশি আগ্রহ ছিল এ খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সচিবসহ কর্তাব্যক্তিদের। কারণ বরাদ্দ অর্থের একটি বড় অংশ যায় কর্তাদের পকেটে-এটি এক রকম ‘ওপেন সিক্রেট’-অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প ব্যয়ের ১৫ থেকে ৩৫ শতাংশ দিতে হয় মন্ত্রণালয় ও রেল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। 

অন্যান্য খুচরা খরচের পর দেখা যায় বাস্তবে বরাদ্দের ৫০ শতাংশ ব্যয় হয় মূল কাজে। এতে এক রকম জোড়াতালি দিয়েই সম্পন্ন হচ্ছে রেলের অধিকাংশ উন্নয়ন কাজ। আর জরাজীর্ণ রেললাইন দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই চলছে ট্রেন। ফলে লাইনচ্যুতির ঘটনাসহ ট্রেন দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। 

রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে রেলওয়ে উন্নয়নে ৯৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাস্তবায়িত অধিকাংশ প্রকল্পের মেয়াদ ২-৩ বার বৃদ্ধি করাসহ ব্যয় বেড়েছে দুই থেকে চারগুণ। ৯৫ প্রকল্পের মধ্যে জরাজীর্ণ রেলপথ, রেলওয়ে ব্রিজ, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ সংস্কারে যথাযথ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। এ সময়ে ক্ষমতাধর বড় কর্তা (রেলপথমন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) শুধু নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে ছুটেছেন। 

মাঠপর্যায়ের কিংবা সরাসরি রেলওয়ে অবকাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নতুন প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন, এখনো আছেন অনেকে। রেলওয়ের সাবেক এক মহাপরিচালক (ডিজি) বলেন, জরাজীর্ণ লাইন নিয়ে মন্ত্রী, সচিবদের সামনে কথাই বলা যেত না।

নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন রেলপথমন্ত্রী ও সচিবের ইশারায় হতো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি রাজনৈতিকভাবে রেলে কাজ করছে। রেলপথ বিভাগের ডিজিসহ কর্মকর্তারা শুধু হুকুম মানেন। প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রকল্পের পিডিকে (প্রকল্প পরিচালক) রেলপথমন্ত্রী এবং সচিবকে ‘ম্যানেজ’ করে কাজ করতে হয়েছে। এসব প্রকল্প থেকে নির্ধারিত ‘পার্সেন্টেজ’ বা ঘুস দিতে হয়েছে ঊর্ধ্বতনদের।

বুধবার ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ষোলশহর এলাকায় তেলবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। প্রতি মাসে এমন লাইনচ্যুত, দুর্ঘটনার সংখ্যা (ছোট-বড়) প্রায় ২২ থেকে ২৫টি। মার্চে ২০ ঘণ্টার ব্যবধানে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ও বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্তে যাত্রীবাহী বিজয় ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়। এতে অন্তত ৭০ যাত্রী গুরুতর আহত হন। 

এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী যুগান্তরকে বলেন, ‘রেলে লাইনচ্যুত কিংবা দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় সাধারণ যাত্রী নিহতসহ গুরুতর আহতও হচ্ছেন। কার্যকর অর্থে রেলপথ সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে দুর্ঘটনা কমে আসত। অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে বলেই লাইনগুলো দিন দিন আরও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে। 

প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে রেলপথে কী পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কী পরিমাণ কাজ করা হয়েছে, সবই খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। নতুন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঠিকাদার, বাস্তবায়নের সঙ্গে থাকা রেলপথমন্ত্রী, সচিবসহ পিডিদের আমলনামা বের করা হবে। একই সঙ্গে জরাজীর্ণ লাইন সংস্কারে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

৭৩ শতাংশ রেললাইন মেয়াদোত্তীর্ণ : রেলপথের প্রায় ৭৩ শতাংশ লাইন এবং ৭৭ শতাংশ রেল ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে বারবার ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০২৩ সালে ২৮৭টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩১৮ জন নিহত ও ২৯৫ জন গুরুতর আহত হন। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, ২০২১ সালে ৪০২টি রেল দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৯৬ জন নিহত হন। ২০২২ সালে ৬০৬টি রেল দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হয়েছেন। 

রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্র বলছে, দুর্ঘটনা-লাইনচ্যুতি কমে আসছে। কিন্তু এখনো যে হারে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে তা বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সারসংক্ষেপ থেকে জানা যায়, চলমান ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে জরাজীর্ণ রেলপথ, রেলওয়ে ব্রিজ সংস্কার, টেকসই মেরামতের কোনো প্রকল্প নেই। এসব প্রকল্পে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। অধিকাংশেই মেয়াদ ও অর্থ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সমাপ্ত প্রকল্পের মধ্যে এমনো রয়েছে, শুরুতে ব্যয় ধরা ছিল ৭ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকায়।

রেলওয়ে অপারেশন, পরিবহণ, রোলিং স্টক ও পরিবহণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৩ হাজার ১১৪.৬৬ কিলোমিটার রেলপথের প্রায় ৯২ শতাংশ স্থানে যথাযথ পাথর নেই। ওইসব স্থানে হুক প্লেট খোলাসহ স্লিপার নড়বড়ে রয়েছে। রেলপথে দায়িত্বরত অতিরিক্ত প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, রেলপথ সংস্কার অর্থ বরাদ্দ নামেমাত্র দেওয়া হয়। 

গত অর্থবছরে দুই অঞ্চলে গড়ে ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিবছর শুধু রেললাইনে ৫ শতাংশ হারে প্রায় ৯০ লাখ সিএফটি পাথর প্রয়োজন। যার মূল্য আসে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। 

পরিবহণ দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, দুই অঞ্চলে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেই বরাদ্দের নামমাত্র কাজ করা হয়। সবই লুট হয়। লাইনে পাথর দেওয়া থেকে শুরু করে, ব্রিজ সংস্কার কিংবা অন্যান্য সংস্কারের ক্ষেত্রে-ছোটখাটো ঠিকাদারের সবাই রাজনৈতিক দলের। রেলপথমন্ত্রীর আত্মীয় কিংবা মন্ত্রীর ইশারা ছাড়া কোনো কাজই হয়নি। 

২০২২ সালে ‘বঙ্গবন্ধু শতবার্ষিকী উদযাপন’ উপলক্ষ্যে রেলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি রেলওয়ে স্টেশন মেরামত-উঁচুকরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এসব প্রকল্পের গুণগত মান দেখে, লিখিত বক্তব্য দিতে রেলের ১০ জন উপসচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

রেল মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিব জানান, বঙ্গবন্ধুর নামে যে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, এর অধিকাংশ অর্থই লুটপাট করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধার সবাই আওয়ামী লীগের ছিলেন। 
আমরা (উপসচিবরা) প্রকল্প নিয়ে কিছুই বলতে পারিনি। একজন অতিরিক্ত সচিব প্রকল্পগুলো সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। সেই অতিরিক্ত সচিব রেলপথমন্ত্রী যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই সব করেছেন। রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর জরাজীর্ণ লাইন সংস্কারে ২০০ কোটি টাকা থেকে কিছু টাকা বরাদ্দের কথা জানালেও রেলপথমন্ত্রী ও সচিব সাড়া দেননি। 

রেলওয়ে রোলিং স্টক দপ্তরে দুর্নীতি পদে পদে-এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের থাকলেও সংশ্লিষ্টরা আওয়ামী লীগ রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকায় কাউকেই শাস্তি পেতে হয়নি। কেনাকাটায় লাগাতার দুর্নীতি হলেও ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

রেলওয়ে প্রকৌশলী বিভাগের সাবেক এক প্রধান প্রকৌশলী জানান, গত ১৫ বছরে উচ্চগতির ইঞ্জিন ও কোচ আনা হলেও ওই সব প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি প্রকল্পে দুর্নীতি হওয়ায় দুদকে মামলাও রয়েছে। শুধু ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকায় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

সূত্র বলছে, উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে ইঞ্জিন-কোচ আনা হলেও সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ যাত্রীরা। ১২০-১৩০ কিলোমিটার গতির কোচ-ইঞ্জিন আনা হলেও বর্তমানে এসব কোচ, ইঞ্জিন গড়ে ৬৪ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলাচল করছে। উচ্চমানের প্রায় ৪০টি ইঞ্জিন ক্রয় করা হলেও পূর্বাঞ্চলের আখাউড়া-সিলেটসহ রেলের বিভিন্ন সেকশনে এসব ইঞ্জিন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। 

শুধু জরাজীর্ণ লাইনের অজুহাতে। তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা ১০টি ইঞ্জিন ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। ৩২২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকায় কেনা এসব ইঞ্জিনে গতিও উঠছে না। লাইন সংস্কার না করে এমন উচ্চ মানসম্পন্ন ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়েও ছিল ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor