Trending

১৮ বছর ধরে নোবেল বিজয়ীদের প্রথম প্রতিক্রিয়া জানতে কল দিয়ে আসছেন তিনি

প্রত্যেক নোবেল জয়ীর গল্পই ভিন্ন, কিন্তু একটি মিল থাকে—তাদের অনুভূতি জানতে অ্যাডাম স্মিথের ফোন।

২০২৩ সালের পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে একজন ফ্রান্সের অ্যান হুইলেয়ার। পুরস্কার জয়ের খবর দেওয়ার জন্য যখন অ্যান হুইলেয়ারকে নোবেল কমিটি থেকে ফোন দেওয়া হয়, তখন তিনি ক্লাসে পাঠদানে ব্যস্ত। একাধিকবার ফোন দেওয়ার পরও, ক্লাসের মাঝে তিনি ফোন ধরেননি। অবশেষে বিরতির সময় ফোন এলে তিনি তা রিসিভ করেন। নোবেল কর্তৃপক্ষ থেকে এক ব্যক্তি অপর প্রান্ত থেকে কথা বলার জন্য সময় চান। অ্যান জানান, আমি একটু ব্যস্ত, শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছি।

তখন সেই ব্যক্তি মাত্র দু-তিন মিনিটের জন্য সময় চান। অ্যানকে নোবেল জয়ের খবর জানানো হলেও, তিনি তেমন কোনো বড় প্রতিক্রিয়া দেখাননি। অনেকটাই নির্বিকার ছিলেন। প্রতিউত্তরে অ্যান হুইলেয়ার শুধু তাকে ধন্যবাদ জানান। ফোন শেষ করেই আবার ক্লাসে ফিরে যান। একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক অ্যানকে তার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আলাদা করা যায়নি।

এভাবে গত ১৮ বছর ধরে নোবেলজয়ীদের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলো যিনি সযত্নে ধরে রাখছেন, তিনি অ্যাডাম স্মিথ। প্রত্যেক নোবেল জয়ীর গল্পই ভিন্ন, কিন্তু একটি মিল থাকে—তাদের অনুভূতি জানতে অ্যাডাম স্মিথের ফোন। 

ফোনটা আসার মুহূর্তে কেউ হয়ত তখনও ঘুমের ঘোরে, কেউ ব্যস্ত নিজের কাজের টেবিলে, আবার কেউ বা তখন আকাশপথে ভ্রমণে। কিন্তু যেখানেই থাকুন না কেন, অনুভূতি জানতে তাদের কাছে অ্যাডাম স্মিথের কল অবশ্যই আসবে। 

তার ফোনের অপর প্রান্ত থেকে উঠে আসে নোবেল বিজয়ীদের প্রথম আবেগ, বিস্ময়, কিংবা অনেক সময় অসাধারণ সাফল্যের পরও বিনম্র প্রতিক্রিয়া। কেমন লাগছে? কী ভাবছেন? এই আনন্দের মুহূর্তে ঠিক কীভাবে নিজের আবেগ সামলাচ্ছেন—স্মিথ সেসব শোনেন মন দিয়ে। অ্যাডাম স্মিথের কণ্ঠের উষ্ণতা ও সাবলীল কথোপকথন বিজয়ীদের জন্য সেই মুহূর্তকে আরও স্মরণীয় করে তোলে। তার কাজ শুধু ফোন করা নয়, বরং বিজয়ীদের আনন্দ, বিস্ময় ও প্রতিফলনের প্রথম মুহূর্তগুলোকে সযত্নে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা।

নোবেল বিজয়ীদের প্রথম ফোনকলটি সাধারণত নোবেল কমিটির সেক্রেটারি বা রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের প্রধানের কাছ থেকে আসে। এই দায়িত্বধারীরা প্রতি কয়েক বছর পরপরই পরিবর্তিত হন। তবে অ্যাডাম স্মিথের গল্পটি একেবারেই আলাদা। তিনি টানা ১৮ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন, যা তাকে একটি বিশেষ ও অনন্য অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

“আমি এত নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে কথা বলেছি, যতজনের সঙ্গে আর কেউ কখনো কথা বলেনি,” স্মিথ বলেন চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে। “এটা ঠিক কতজন হতে পারে, আমি আসলে জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, একবার হিসেব করা উচিত।”

অ্যাডাম স্মিথ এই ফোনালাপগুলোকে শুধু একটি আনুষ্ঠানিক কথোপকথন হিসেবে দেখেন না, বরং এটি নোবেল বিজয়ীদের সঙ্গে একটি নতুন কাজের সম্পর্কের সূচনা। বিজয়ীরা পরে নোবেল প্রাইজ আউটরিচের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নেন, যেখানে তারা তরুণ বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।  

স্মিথের নেতৃত্বে তৈরি করা নোবেল বিজয়ীদের জীবনের অসাধারণ মুহূর্তগুলো ‘নোবেল প্রাইজ কনভার্সেশনস’ পডকাস্টের অংশ হিসেবে সংরক্ষিত করে রাখা হয়।

স্মিথ বলেন, “আমি যখন ফোন করি তখন অনেক সময় দেখা যায়, তারা মাত্রই খবরটি জানতে পেরেছেন, তখনও হয়ত কারো সঙ্গে কথা বলেননি। এটা একেবারে সঠিক মুহূর্ত, যখন তারা আবেগ প্রকাশে একটু অপ্রস্তুত থাকেন। ” 

তবে সবসময় সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হয় না। কখনো কখনো, যদি নোবেল কমিটি বিজয়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়, তখন স্মিথের থেকেই তারা প্রথম ফোনটি পান। 

যেমন, ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী হন পিটার হিগস—তিনি অত্যন্ত ব্যক্তিগত জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ঘোষণার দিন তিনি ফোন ছাড়া মধ্যাহ্নভোজে বেরিয়েছিলেন। নোবেল জয়ের সংবাদ প্রথম জানতে পেরেছিলেন তার পুরোনো এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে, যিনি গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশে হিগসকে অভিনন্দন জানান।

আরেকটি ঘটনায়, ২০০৪ সালে চিকিৎসায় নোবেল জয়ী লিন্ডা বাকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কমিটি তার কর্মস্থলের পরিচালককে ফোন করে। সিয়াটলে রাত ২টায় ফোন পেয়ে সেই পরিচালক প্রথমে বিরক্ত হয়ে ভেবেছিলেন, কেউ হয়ত চাকরির জন্য তদবির করছেন। পরে বুঝতে পারেন, এটি নোবেল কমিটির ফোন।

অনেক পুরস্কার বিজয়ী আনুষ্ঠানিক সংবাদ পাওয়ার আগে থেকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন যে তিনি নোবেল পেতে যাচ্ছেন। হিগসের মতো তখন অনেকে জনসমক্ষে না এসে দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে চান। আবার অনেকে প্রতি বছর ঘোষণার রাতেই বিছানার পাশে একটি ক্যামেরা রাখেন, যাতে তারা আনন্দের মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে পারেন, বলেন স্মিথ। 

তার ভাষ্যে, “নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে আঁচ করতে না পারাটা অস্বাভাবিক। তবে এটি এমন কিছু নয়, যার জন্য অপেক্ষা করা উচিত—এতে মানসিক চাপ বাড়তে পারে”। 

২০২০ সালের রসায়নে নোবেল জয়ী এম্যানুয়েল চার্পেন্টিয়র জানান, জিন সম্পাদনার যন্ত্র ক্রিস্পার-ক্যাস৯ নিয়ে মৌলিক কাজ করার পর, তাকে ‘হাজার হাজার’ বার মনে করে দেয়া হয়েছিল যে ভবিষ্যতে তিনি নোবেল পেতে যাচ্ছেন। 

একইভাবে, এবছর রসায়নে নোবেল বিজয়ী জন জাম্পার অনেকটা আগে থেকে ধারণা করতে পেরেছিলেন যে তিনি পুরস্কার জেতার দৌড়ে রয়েছেন। ডেমিস হ্যাসাবিসের সাথে মিলে একটি এআই মডেল তৈরি করেছেন তিনি, যা ৫০ বছরের পুরোনো একটি সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। এই এআই মডেলটির নাম ‘আলফাফোল্ড২’, যা প্রোটিনের জটিল কাঠামোর পূর্বাভাস দিতে পারে।

একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আপনি যদি আলফাফোল্ডের মতো একটি এআই মডেল নির্মাণ করতে চান, তাহলে জীবন নিয়ে সোজাসাপটা চিন্তা করার সক্ষমতা থাকতে হবে”। 

“নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার ১০ শতাংশ সুযোগ ছিল”, যোগ করেন জাম্পার। 

কিন্তু বেশিরভাগ নোবেল বিজয়ী তাদের আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে আরও সতর্ক থাকেন। স্মিথ বলেন, “যদিও একজন বিজয়ী মনে করতে পারেন যে এটি কখনো ঘটতে পারে, কিন্তু সম্ভবত তাদের বহু বছর ধরে এই অপেক্ষা চলতে থাকে। অনেকেই একাধিকবার চেষ্টা করলেও সফল হননি, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো মিথ্যা খবরও পেয়েছেন।”

ছবি: নোবেল প্রাইজ আউটরিচ

এত সব প্রত্যাশা, অপেক্ষা, প্র্যাঙ্ক কল এবং বছরের পর বছর হতাশার মধ্যেও—দিনশেষে তাদের প্রতিক্রিয়া হয় অবিশ্বাস্য বিস্ময়ের। স্মিথ বলেন, “হয়ত তিনি অনেকবার শুনেছেন যে একদিন তিনিও নোবেল পেতে পারেন, যখন এটি আসলেই ঘটে তখন তারা সত্যিই অবাক হন, যেন দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা; আমি বলব, প্রায় সব ক্ষেত্রেই।”

তবে এটি বলা যায় না যে সকলের প্রতিক্রিয়া একই হয়। কখনো কখনো নতুন বিজয়ীরা স্মিথের ফোনকল পেয়ে কিছুটা বিরক্ত হন। ২০১০ সালে গ্রাফিন আবিষ্কারের জন্য নোবেল জয়ী কনস্টানটিন নোভোসেলভ এবং ২০১৮ সালে লেজার ব্যবহার করে ক্ষুদ্র বস্তুকে স্থানান্তরের জন্য নোবেল জয়ী আর্থার অ্যাশকিন, দুজনেই স্মিথের ফোনকল পেয়ে বলেছিলেন: “আপনি কি বলতে চাইছেন আমাকে আমার পরীক্ষা থামাতে হবে? আমি তো ব্যস্ত আছি।”

ডরিস লেসিং ২০০৭ সালে সাহিত্যে নোবেল জিতেছিলেন। যখন তিনি ট্যাক্সি থেকে নেমে খবরটি শোনেন তখন তার হাতে ছিল বাজারের ব্যাগ। 

খবরটি দেওয়া এক সংবাদদাতার প্রতি তার প্রতিক্রিয়া ছিল কিছুটা বিরক্তের। তিনি সাংবাদিককে হাত নেড়ে বলেছিলেন, “ওহ, ক্রাইস্ট,” এবং তারপর বাজারের ব্যাগগুলো মাটিতে ফেলে দেন।

স্মিথ বলেন, “এর কিছুক্ষণ পরই আমি তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমি জানতাম কী ঘটেছিল এবং ভাবলাম, ‘এই কলটা হয়ত ভালো যাবে না।'”

ডরিস লেসিং ২০০৭ সালে সাহিত্যে নোবেল জিতেছিলেন। যখন তিনি ট্যাক্সি থেকে নেমে খবরটি শোনেন তখন তার হাতে ছিল বাজারের ব্যাগ।

কিন্তু আসলে স্মিথ ওই কল নিয়ে ‘দারুণ খুশি’ ছিলেন। “আমরা বেশ সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলাম, এবং তিনি কথোপকথনে মজা পাচ্ছিলেন। এটা এমন একটি কল ছিল, যেটা নিয়ে আমি গর্বিত ছিলাম, কারণ শুরুতে মনে হয়েছিল এটি সম্ভবত বেশ কঠিন হবে”, বলেন স্মিথ। 

২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এলিস মুনরোর সঙ্গে ফোনের আগেও কিছুটা চিন্তিত ছিলেন স্মিথ। তবে কথোপকথনটি বেশ ভালোভাবেই হয়েছিল। স্মিথ এ অভিজ্ঞতাকে ‘উত্তেজনাপূর্ণ’ বলে বর্ণনা করেন এবং মুনরোকে একজন দারুণ সাক্ষাৎকারদাতা হিসেবে উল্লেখ করেন।

কিছু কিছু ফোনকলে স্মিথকে খুব সতর্ক থাকতে হয়। এর মধ্যে একটি ছিল ২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জয়ী রজার পেনরোজের সাথে।

স্মিথ বলেন, “তিনি এত দ্রুত চিন্তা করেন, আর দ্রুত কথা বলেন। কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা মহাবিশ্বের শেষ, বিশাল ব্ল্যাক হোল, এবং পরবর্তী মহাবিশ্বে ফিরে আসার বিষয়ে কথা বলছিলাম। আপনি বুঝতেই পারছেন, কথার মধ্যে অনেক দূর পাড়ি দিয়েছি।”

“মনে হচ্ছিল যেন ঘোড়ার পিঠে উঠে আছি, আর পড়ে না যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে লেগে আছি,” যোগ করেন তিনি। 

১৮ বছর ধরে এই ফোনকলগুলো করলেও, স্মিথ এখনও নতুন নোবেল বিজয়ীদের তাদের জয়ের আনন্দের সময় বিরক্ত করতে কিছুটা দ্বিধায় থাকেন, বিশেষ করে যদি সেটা মাঝরাতে হয়। 

তিনি বলেন, “এইভাবে মানুষকে খুঁজে ফোন করা খুব আরামদায়ক নয়। যদিও ফোনে কথা বলার পর তারা খুশি হন, তবুও আপনি জানেন আপনি তাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করছেন।”

তিনি বলেন, “আপনি বুঝতে পারেন আপনি কারও সাথে সত্যিই সংযোগ করতে পেরেছেন কি না, তারা আপনাকে মনোযোগ দিয়েছে কি না, নাকি কথোপকথন খুবই আনুষ্ঠানিক হয়ে গেছে। যদি সংযোগ করতে পারি, সেটা খুবই আনন্দের। আর যদি তা না হয়, সেটা হতাশার। এমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে।”

“এই ফোনকলের মাধ্যমে আমি মূলত বলতে চাই, ‘হ্যালো, কেমন আছেন? অভিনন্দন! এখন আপনার অনুভূতি কেমন?’ এবং তাদের জীবন বদলে যাওয়া সেই মুহূর্তের সাক্ষী হতে চাই”, বলেন স্মিথ। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d