Hot

২০ টাকার ওষুধ ৩০ টাকা! চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আর্থিক বিপর্যয়ে মানুষ

বাতের চিকিৎসায় খাদ্য সম্পূরক হিসেবে ব্যবহৃত ‘আর্থ-এ টিএস’ ট্যাবলেট কয়েক দিন আগেও ২০ টাকা করে পাওয়া গেলেও এখন প্রতিটির দাম বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা। অর্থাৎ ট্যাবলেটপ্রতি দাম বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। এ ছাড়া বেড়েছে সর্দিজ্বর, চর্মরোগ, অ্যালার্জি, শ্বাসনালির সংক্রমণ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের দাম।

দেখা গেছে, ওষুধের দাম সর্বনিম্ন ২০ এবং সর্বোচ্চ ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।

গড়ে দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। গত কয়েক দিন চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় ওষুধের বিভিন্ন খুচরা ও পাইকারি দোকান ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন বছরের শুরুতেই এসব ওষুধের দাম বেড়েছে।

শ্বাসনালির সংক্রমণসহ বিভিন্ন সংক্রমণে ব্যবহৃত ফ্লুক্লক্স প্রতি বক্স ৮০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৫ টাকা। অ্যালার্জির ট্যাবলেট ফেক্সো প্রতি পাতায় বেড়েছে ১০ টাকা, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ওসারটিল প্রতি পাতায় বেড়েছে ২০ টাকা, এনজিলক বক্সপ্রতি বেড়েছে ১০০ টাকা, হার্টের ওষুধ নাইট্রোকার্ড প্রতি বক্স ট্যাবলেটের দাম ১২০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪২০ টাকা।

অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-৩ প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৪৫ টাকা। ভিটামিন বি সমৃদ্ধ নিউরোজেনের দাম প্রতি প্যাকেটে ২০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৬০০ টাকা।

ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দর, জ্বালানি সরবরাহ কমে যাওয়া এবং কাঁচামাল ক্রয়ে ডলার সংকট ওষুধের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না তাঁরা।

সমিতির তথ্য মতে, দেশে ২১৩ স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যারা দেশের মোট ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে। দেশে ওষুধের বাজার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের ১৫৭ দেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকে। গত সাত বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে হয়েছে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার।

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয়ে মানুষ

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ের অংশ প্রতিবছর কমছে। বিপরীতে ব্যক্তির পকেটের খরচ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করছে ব্যক্তি নিজেই।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে। আবার ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। তবে এই ধারা শুধু তিন বছরের নয়, এই প্রবণতা দুই দশকের বেশি সময়ের।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ঊর্ধ্বমুখী পণ্যমূল্যের বাজারে মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। জীবনমান নিম্নমুখী, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে ওষুধের দাম যে মাত্রায় বাড়ানো হয়েছে, তা অযৌক্তিক ও অন্যায়। ভোক্তার অধিকার উপেক্ষা করে এমন মূল্যবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত নয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ওষুধের দাম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় কারণে হতদরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে থাকছে। এর মধ্যে দাম যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে চিকিৎসাবৈষম্য আরো বাড়বে। সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে।

অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ওষুধের দাম নির্ধারণ হওয়া উচিত দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। উৎপাদন খরচ মুখ্য হতে পারে না। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে। এভাবে চলতে থাকলে বিভিন্ন রোগব্যাধিও বাড়বে। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা মানুষ, যাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, তাদের অবস্থা আরো করুণ হবে। এ জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেশি করে বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া উচিত, যাতে হাসপাতালের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে না হয়।

কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে আনা দরকার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে কারণে বাড়ে, ওষুধপত্রের দাম সংগত কারণে বাড়তে পারে। কারণ ওষুধের কাঁচামাল এখনো বাইরে দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কাঁচামালের সঙ্গে ডলারের দামের তারতম্য হলে স্বাভাবিকভাবেই ওষুধের দাম বাড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার ওষুধের দাম বাড়তে দেবে কি না। কারণ অন্য দশটি জিনিসের মতো ওষুধের বিকল্প হয় না।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ওষুধের দাম বেড়ে গেলে যদি মানুষ ওষুধ কিনতে না পারে, নিয়মিত ওষুধ খেতে না পারে, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার পরিবার, সমাজ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য সরকারকে সতর্ক থাকা উচিত। তিনি বলেন, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় হলো কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে দেওয়া। আরেকটা হলো, ওষুধ কম্পানিগুলোর প্রমোশন ও মার্কেটিং খরচ কমিয়ে আনা। বিশেষ করে চিকিৎসকদের কমিশন কমিয়ে দেওয়া। এ কাজটি সব ওষুধ কম্পানিকে এক হয়ে করতে হবে।

গত এক দিন আগে অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়া ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা নুরুল আলম বলেন, ‘বাজারে প্রায় এক হাজার ৭০০ জেনেরিক ওষুধ রয়েছে। এর মধ্যে ১১৭টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। বাকিগুলো কম্পানি নিজেরাই নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন থেকে অনুমোধন নেয়। তারা কাঁচামাল, উৎপাদন খরচ, প্যাকেজিং খরচের বিষয়ে জানিয়ে ভ্যাট প্রদানের নিমিত্তে মূল নির্ধারণের জন্য ঔষধ প্রশাসনে দাখিল করে। ঔষধ প্রশাসন যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন করে।’

ওষুধ ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি মাসে এসব ওষুধের দাম বেড়েছে। কম্পানিগুলো ধাপে ধাপে নিজেদের ওষুধের দাম বাড়ানো অব্যাহত রাখলেও ভোক্তারা বাগবিতণ্ডায় জড়াচ্ছে বিক্রেতাদের সঙ্গে।

হাটহাজারীর চৌধুরীহাটের আরাফাত টাওয়ারের পাশে একটি ওষুধের দোকান রয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই দোকানের বিক্রেতা বলেন, ‘গত ৪ মার্চ থেকে সর্বশেষ বর্ধিত দাম অনুযায়ী আমরা ওষুধ বিক্রি করছি। কিন্তু ওষুধ কিনতে আসা বিভিন্ন রোগী ও স্বজনরা দাম বেড়েছে শুনে আমাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়াচ্ছে।’ 

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিকের ওষুধ খাচ্ছেন এক রোগী। আজ (গতকাল) সকালে ওই রোগী ‘গ্লিপিটা’ ট্যাবলেট খেয়ে এলেও দাম বেড়ে যাওয়ায় (প্রতি বক্সের ৩০ ট্যাবলেট দাম ৪২০ থেকে এখন ৪৮০ টাকা) পরে দাম না বাড়ানো ‘সিগ্লিমেট’ কেনেন। ‘গ্লিপিটা’ প্রতি ট্যাবলেট এখন ১৬ টাকা এবং ‘সিগ্লিমেট’ ১৪ টাকা।

গতকাল চট্টগ্রাম নগরে ওষুধের পাইকারি বাজার হাজারী লেন গিয়ে দেখা যায়, পাইকারি দোকান বেশির ভাগ বন্ধ। খুচরা কয়েকটি দোকান খোলা। বিকেল পৌনে ৩টার দিকে রশিদ মার্কেটের প্রবেশমুখে এক দোকানের বিক্রেতা বলেন, ‘ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। আমরা তো দাম বাড়াইনি। কিন্তু দাম বেশি দেখে আমাদের সঙ্গে ক্রেতাদের ঝগড়া হচ্ছে।’

হাজারী লেন থেকে ওষুধ কেনা জমির উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, “আগে প্রেশারের ওষুধ ‘বিসোরেন’ ২.৫ এমএল ট্যাবলেট কিনেছি ১৮০ টাকায় (প্রতি বক্সে ৩০টি)। আজ (গতকাল) নিল ২১০ টাকা। ওনারা (বিক্রেতা) বলেছেন, এক সপ্তাহ ধরে নতুন নির্ধারিত দামে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে।”

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক আশীষ ভট্টাচার্ষ গতকাল বিকেলে বলেন, ‘ওষুধ কম্পানিগুলো গড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। ভোক্তারা ওষুধ কিনতে এসে দাম বাড়ার বিষয়টি নিয়ে নানা কথা বলছে। তাদের সব প্রশ্নের সদুত্তর আমরা দিতে পারছি না। তবে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও সংকটের কারণে ওষুধের কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে ওষুধের দাম বেড়েছে।’

ঔষধ প্রশাসন চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক এস এম সুলতানুল আরেফিন বলেন, সরকার থেকে অনুমোদন নিয়ে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম বাড়ার কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তা ঠিক। কমবেশি সব কম্পানির বিভিন্ন ওষুধের দাম ধাপে ধাপে বাড়ছে। একসঙ্গে নয়।

ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, কোনো ওষুধের দাম বাড়েনি। তবে সব প্রতিষ্ঠান ওষুধের দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে।

তাহলে দোকানে কেন ওষুধের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাতে গোনা দু-তিনটি ওষুধের দাম বাড়লেও বাড়তে পারে। তবে বাজারে যেসব ওষুধের দাম বাড়তি, সেগুলো ছয় মাস আগে বেড়েছে।

শফিউজ্জামান বলেন, মূল্যবৃদ্ধির পর বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে তা কার্যকর হতে দু্ই-তিন মাস বা এরও বেশি সময় লাগতে পারে। ওষুধের সরবরাহ, মজুদের ওপরও এগুলো নির্ভর করে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d