২৮শে অক্টোবর কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
২৮শে অক্টোবরকে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণী দিন। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। লাখ লাখ লোকের মহাসমাবেশ কয়েক মিনিটে পণ্ড হয়ে যায় পুলিশি অ্যাকশনে। চালকের আসন থেকে ব্যাকফুটে চলে যায় বিএনপি। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বৃহৎ এই দলটি। কিন্তু কী ঘটেছিল সেদিন। কেন ব্যর্থ হয়েছিল ওই দিনের বিএনপির মহাসমাবেশ। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কাজী সুমন। বছরজুড়েই অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি বড় বড় সমাবেশ করে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করেছিল বিএনপি। ১৮ই অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশ থেকেই সরকার পতনের মহাযাত্রা শুরু হবে।
তখন থেকেই সরকারের মধ্যে একধরনের ভীতি ও অস্বস্তি তৈরি হয়। পরদিন থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশে বিএনপি নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়। সাঁড়াশি অভিযান চলে রাজধানীর হোটেলে হোটেলে। পুলিশি অভিযানের মধ্যে নানা কৌশলে সারা দেশ থেকে রাজধানীতে ঢুকে পড়েন বিএনপির কয়েক লাখ নেতাকর্মী। ২৭শে অক্টোবর সন্ধ্যারাত থেকেই নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়। মধ্যরাতে কার্যালয়ের সামনে ট্রাকে মঞ্চ বানানো হয়। ভোর হতেই নয়াপল্টনমুখী নেতাকর্মীদের স্রোত শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের ঢলও বাড়তে থাকে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ঢল ঠেকাতে ঢাকার সবগুলো প্রবেশমুখে ব্যারিকেড বসানো হয়। যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। নানা কায়দায় ঢাকায় ঢুকেন নেতাকর্মীরা। সকাল ১০টা বাজতেই লোকারণ্য হয়ে পড়ে পুরো নয়াপল্টন এলাকা। মানুষের ঢল পূর্বদিকে ফকিরাপুল, পশ্চিমদিকে কাকরাইল মসজিদ পেরিয়ে মৎস্যভবন, উত্তরদিকে মালিবাগ মোড় ও দক্ষিণদিকে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।
যেভাবে সংঘর্ষের সূত্রপাত
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাকরাইল মসজিদের সামনে দিয়ে কয়েকটি বাসে করে আওয়ামী লীগের সমাবেশের দিকে যাচ্ছিল গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী-সমর্থকরা। এসময় তাদের দেখে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দেন সেখানে উপস্থিত বিএনপির সমর্থকরা। মুহূর্তেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। বেঁধে যায় দুপক্ষের সংঘর্ষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। ছোড়ে কাঁদানে গ্যাস। সংঘর্ষ আরও ছড়িয়ে পড়ে। কাকরাইল মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের একটি বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। একপর্যায়ের পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বেলা ১টার দিকে শক্তি বাড়িয়ে অলআউট অ্যাকশনে যায় পুলিশ। কাকরাইল মোড়ের দিক থেকে এপিসি ও রায়ট কার নিয়ে মুহূর্মুহু সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে র্যাব-ডিবি ও পুলিশের যৌথবাহিনী। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিজিবিও। কয়েক মিনিটের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় বিএনপি নেতাকর্মীরা। নয়াপল্টনের আশপাশের অলিগলিতে আশ্রয় নেন তারা। সিনিয়র নেতারা বক্তব্য দেয়া বন্ধ করে নিরাপদে সরে যান। তবে গুটি কয়েকজন নেতাকর্মী প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। পাল্টা ইটপাটকেল ছুড়েন তারা। সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দেন। বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কাকরাইল, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, বিজয়নগর এলাকায় থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। এসময় বেশ কিছু যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। এপর্যায়ে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পিছু হটেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্যসহ দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হন।
কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব
বেলা ৩টার দিকে তুমুল গুলিবর্ষণ ও সাউন্ড গ্রেনেডের কারণে পুরো নয়াপল্টন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। তখন মঞ্চে আসেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। হ্যান্ডমাইকে তিনি বলেন, বিএনপি’র শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ ‘আওয়ামী লীগ ও পুলিশ যৌথ হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দিয়েছে। এসময় পাশ থেকে ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম ও দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল তাকে হরতালের ঘোষণা দেয়ার জন্য বারবার চাপ দেন। তখন মির্জা ফখরুল ২৯শে অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন। ঘণ্টাখানেক পরেই বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন- ২৯শে অক্টোবর সকাল-সন্ধ্যা নয়, আধাবেলা হরতাল। এ নিয়ে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। এতে ক্ষুব্ধ হন সিনিয়র নেতারা। কিছুক্ষণ পর সংশোধন করে ফের বিবৃতি দেন রিজভী।
নিরাপত্তা বলয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের সমাবেশ, অরক্ষিত ছিল বিএনপি
২৮শে অক্টোবর বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সমাবেশ ডেকেছিল। সকাল থেকেই শাপলা চত্বর ঘিরে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে র্যাব-পুলিশ। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করতে অটল থাকে জামায়াত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যারিকেডের পাশে জড়ো হতে থাকেন জামায়াত নেতাকর্মীরা। উত্তেজনা তৈরি হয় মতিঝিল এলাকায়। একপর্যায়ে সমঝোতা হয় পুলিশ ও জামায়াত নেতাদের মধ্যে। তাদের শাপলা চত্বরের বদলে আরামবাগে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়। নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে দিনব্যাপী নিরাপদে সমাবেশ করে জামায়াত। নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে যৌথবাহিনীর হামলা চললেও কয়েক শ’ গজ দূরে জামায়াতের সমাবেশে কেউ একটি ঢিলও ছুড়েননি। এমন কি নয়াপল্টনে হামলার প্রতিবাদে বিএনপির মিত্র হিসেবে জামায়াত নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি।
ওদিকে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের সমাবেশকে ঘিরেও কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। পুরানা পল্টন, জিপিও, দৈনিক বাংলা মোড় এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সমাবেশ ঘিরে র্যাব-পুলিশের সদস্যরা সার্বক্ষণিক পাহারা দেন। নয়াপল্টনে সংঘর্ষ চলাকালেই আওয়ামী লীগের সমাবেশে কিছুক্ষণ পরপর গুজব রটে, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা হামলার জন্য আসছে। এ খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সমাবেশ চত্বরে। দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তখন মঞ্চ ও সমাবেশ থেকে না পালাতে কর্মীদের অনুরোধ করেন সিনিয়র নেতারা। এদিকে সকাল থেকেই অনেকটা অরক্ষিত ছিল বিএনপির মহাসমাবেশ। বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর নিরাপত্তা রক্ষায় অল্প সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল মোড়ে মোড়ে। যে তুচ্ছ ঘটনাটি নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে সংঘাত এড়ানো যেতো বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
সঠিক পরিকল্পনার অভাব
বড় মহাসমাবেশ সফল করতে কী কী পরিকল্পনা নেয়া দরকার সেটা নিয়ে হোমওয়ার্ক করেনি বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। এছাড়া সরকার কী কৌশল নিচ্ছে সেটাও জানার চেষ্টা করেননি বিএনপি নেতারা। এক সপ্তাহ আগেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট করে বেলছিলেন, হেফাজতের যে পরিণতি হয়েছিল সেটার জন্য বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে। সারা দেশ থেকে আসা লাখ লাখ নেতাকর্মীর শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দল থেকে কোনো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়নি। সমাবেশের পরিধি যখন ধারণাতীত এলাকা ছাড়িয়ে যায় তখন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেনি দলটি।
কাকরাইল মসজিদের সামনে যখন হামলা-সংঘর্ষ চলছিল সেখবর তাৎক্ষণিক নয়াপল্টনের মঞ্চের নেতারা পাননি। এছাড়া পুলিশ সমাবেশে হামলা চালাতে পারে- এ ধরনের কোনো পূর্ব ধারণা করতে পারেননি দলটির নেতারা। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষে ঘেরাও কর্মসূচি দেয়ার কথা ছিল বিএনপির। সেজন্য একেবারে খালি হাতে সমাবেশে যোগ দেন নেতাকর্মীরা। কোনো ধরনের হামলা মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি তাদের ছিল না। তাছাড়া দলের ভেতরে কোনো সমন্বয় ছিল না। তাদের যতসব কৌশল সরকারের টেবিলে আগেই পৌঁছে যায়। জামায়াতসহ রাজপথে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সেভাবে লিয়াজোঁ করতে পারেনি বিএনপি। জামায়াতকে এক মঞ্চে তোলা নিয়ে দলের ভেতরেই প্রচ্ছন্ন দুটি মত স্পষ্ট হয়ে উঠে। এতে করে জামায়াত দূরত্ব বজায় রেখেই কর্মসূচি দেয়। এখানে অবশ্য অন্য একটা শক্তি কলকাঠি নাড়ছিল।
নয়াপল্টন কার্যালয়ে বাইডেনের ‘কথিত’ উপদেষ্টা
সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর সন্ধ্যায় নয়াপল্টন কার্যালয়ে হাজির হন মিয়া আরেফি নামে এক মার্কিন নাগরিক। নিজেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তার পাশে ছিলেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন ও লে. জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী। এ ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে বিএনপি। পরে জানা যায়, তিনি বাইডেনের উপদেষ্টা নন। তার পুরো নাম জাহিদুল ইসলাম আরেফী। ডাক নাম বেল্লাল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে থাকেন, বাংলাদেশি আমেরিকান। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রে বাস করলেও তিনি মাঝেমধ্যেই দেশে আসেন। এ ঘটনার দুদিন পর বিমানবন্দর থেকে মিয়া আরেফিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেন তিনি বিএনপি কার্যালয়ে এসেছিলেন, মিডিয়াকে কারা আগাম খবর দিয়ছিল সেটা নিয়েও রয়েছে অপার রহস্য।
সরকার চায়নি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। একাধিক জরিপ রিপোর্ট থেকে সরকার জানতে পারে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে তাদের জয়ের সম্ভাবনা নেই। তাই তারা শুরু থেকেই কৌশল নেয় বিএনপি যাতে নির্বাচনমুখী না হয়। বিএনপির ভেতরে এই সরকারের অধীনে কোনও নির্বাচন নয়, এমন ধারণা দিতে থাকে একটি সুসংগঠিত গ্রুপ। যাতে করে পরিবর্তিত কোনো পরিস্থিতিতেও দলটি যাতে নির্বাচনে অংশ না নেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবে না এই সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক মহলেও এ নিয়ে নানা সংশয় তৈরি হয়। পুলিশি অ্যাকশন চলতেই থাকে। বিএনপির প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হন মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস সহ দলের সিনিয়র নেতারা। লাখ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছাড়া হয়ে যান। এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বাড়িঘরে ফিরতে পারেননি অনেক নেতাকর্মী।