Bangladesh

২ সিটির সীমানা ফাঁদে ২২০০ কোটি

এক শহর, একই সড়ক। সেই সড়কেই খন্ডিত প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে একই সড়কে দুই রকম রূপ ধারণ করবে। কাক্সিক্ষত সুফলও মিলবে না। একইভাবে মেট্রো করিডরেও খন্ডিত প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর দুই নগর সংস্থার এমন প্রকল্পে খরচ হবে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু খন্ডিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কাক্সিক্ষত সুফল যেমন মিলবে না, তেমনি এ অর্থ অপচয় হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া এই ধরনের প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নেওয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

ঢাকা দক্ষিণের আট লেন প্রকল্প : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রায়েরবাজার সøুইসগেট থেকে পুরান ঢাকার লালবাগের লোহার ব্রিজ পর্যন্ত আট লেনের দ্রুতগামী সড়ক নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। এখানে বরাদ্দ করেছে ৯৭৪ কোটি টাকা। এ সড়কটি এখন বাবুবাজার থেকে গাবতলী পর্যন্ত চার লেনের। রায়েরবাজার পর্যন্ত আট লেন হলে গাবতলী পর্যন্ত বাকি প্রায় ১০ কিলোমিটার অংশ চার লেনই থেকে যাবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে সংশোধিত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) ‘ইনার সার্কুলার রোড’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকার বেড়িবাঁধ সড়কটি ইনার সার্কুলার সড়কের অংশ। চার লেনের এই সড়কটি আট লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ডিএসসিসি লালবাগ এলাকার লোহার ব্রিজ থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত অংশের ৫ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ কাজ করবে। ২০ ফুট প্রশস্ত সড়কটি হবে ১৪০ ফুট। কোন সংস্থা ওই সড়কের উন্নয়ন করবে তা কারও জানা নেই। গত ৩১ অক্টোবর অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।

আংশিক সড়ক প্রশস্ত করে সুবিধার চেয়ে বিড়ম্বনা ও জটিলতা বাড়বে। কারণ আট লেন সড়ক থেকে চার লেনে আসার পর যানবাহনের গতি কমে যাবে। ফলে যানজট তৈরি হবে। সৃষ্টি হবে জনদুর্ভোগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণের সময় দুই সংস্থা সমন্বয় সভা করে প্রকল্প গ্রহণ করলে পুরো সড়কটি একত্রে বা একটি প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। প্রকল্পের সমীক্ষাসহ অন্যান্য ব্যয়ও কম হতো।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, রায়েরবাজার

থেকে লালবাগের লোহার ব্রিজ পর্যন্ত চার লেনের সড়ককে আট লেনে উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকার ডিএসসিসির একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। তবে এখনো প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়নি। তবে ওই সড়কের বাকি অংশ অর্থাৎ রায়েরবাজার থেকে গাবতলী পর্যন্ত অংশে উত্তর সিটি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে শুনিনি। ওই অংশ সড়ক ও জনপথ বিভাগও বাস্তবায়ন করতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে।

মেট্রোরেল করিডর বিষয়ে তিনি বলেন, মেট্রো করিডরের উত্তরাঞ্চলের প্রশস্ত সড়ক থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশের কারওয়ান বাজার পর্যন্ত এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে তেমন কিছু ডিএসসিসি জানেন না। তবে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বলেন, ‘যেকোনো সড়কের আংশিক প্রকল্প না হয়ে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে সেটায় ভালো সুবিধা মিলবে, এটাই স্বাভাবিক। অনেক ক্ষেত্রে বাজেটসহ নানা কারণে তা বাস্তবায়ন করা যায় না।’

মেট্রোরেল করিডর প্রকল্প : অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ যেহেতু করেছে, ঢাকা উত্তর সিটি কেন বাকি থাকবে। এই নগর সংস্থাও একই পথে হাঁটতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় মেট্রো করিডরে সড়ক, ফুটপাত ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। মেট্রো করিডর উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) অংশে। জনবান্ধব এ প্রকল্পটি কারওয়ান বাজারে এসে শেষ হবে। এতে ঢাকা দক্ষিণ সিটির অংশের মেট্রো করিডরের সড়ক বেহাল থাকবে। ইতিমধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ পর্যায়ে। বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রাক-সমীক্ষার কাজ করা হয়েছে। মেট্রো করিডরের সমস্যা বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। ডিএনসিসি সেসব সুপারিশ পর্যালোচনা করেছে। তারই আলোকে সমীক্ষা পরিচালনার কাজ করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগিরই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হবে জানা গেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উত্তরা থেকে মতিঝিল হয়ে মেট্রোরেল গেছে কমলাপুর। মেট্রোর নিচের সড়কের দূরত্ব ২১ কিলোমিটার। এই করিডরের একটি অংশ পড়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। ওই অংশের উন্নয়নের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বিশ্বব্যাংক যে প্রাক-সমীক্ষা পরিচালনা করেছে সেখানে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা সুপারিশ করেছে। তবে দেশে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের আইনে নিষিদ্ধ সমকামীদের জন্যও বিশেষ সুবিধা সংবলিত অবকাঠামো নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে ওই সমীক্ষায়।

ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী নাঈম রায়হান খান বলেন, মেট্রো করিডরের ডিএনসিসি অংশের আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এখানে বিশ্বব্যাংক ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রকল্প গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, মেট্রো করিডরের যাত্রীসেবা কেমন হবে, সে বিষয়ে একটি সমীক্ষা হয়েছে। সেখানে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সেসব বিষয় বিবেচনা করা হবে। মেট্রো করিডরে প্রকল্প বাস্তবায়নে শিগগিরই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরুর প্রক্রিয়া করবে ডিএনসিসি।

ঢাকার দুই সিটির কয়েকজন প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা জানান, ঢাকা শহরে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভয়াবহ সমন্বয়হীনতা চলছে। এটা বেশি ঘটছে ঢাকার দুই সিটির ক্ষেত্রে। দুই সংস্থা আলোচনা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে এসব সমস্যা থেকে এড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সফলতাও বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় ঘটে।

তারা আরও জানান, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন পৃথক হওয়ার পরও সমন্বিতভাবে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে এক সংস্থা থেকে প্রকল্প পরিচালক এবং অন্যান্য প্রকল্প কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়ে থাকে। সেসব প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নও হয়েছে। দুই সিটির প্রকল্প বাস্তবায়নের এমন সুন্দর দৃষ্টান্ত থাকার পরও আবারও কেন খ-িত প্রকল্প প্রকল্প গ্রহণ এমন প্রশ্ন তাদেরও।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা : জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এক শহর, একই করিডর, সেখানে অর্ধেকাংশে কাজ হবে। আর বাকি অর্ধেকে কাজ হবে না, এটা তো চিন্তাই করা যায় না। দুই কর্তৃপক্ষ সমন্বয় করে করলে এখানে অনেক অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো।

তিনি বলেন, ‘এক সিটি করপোরেশনকে দুই সিটি করপোরেশন করার সময় সরকার যে আশার বেলুন ফুলিয়ে ছিল, তা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তার ন্যূনতম কিছু থাকলে দুই সংস্থার মধ্যে এমন সমন্বয়হীনতা দেখতে হতো না। কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামগ্রিকতা বিবেচনা করে কাজ করলে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘সিটি করপোরেশন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে ডিটিসিএর অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা মানছে না। ঢাকার দুই সিটি মেয়র ওই কমিটির সদস্য হলেও তারা সে নিয়মের প্রতি কর্ণপাত করছেন না। ওই নিয়ম মানলে এই খন্ড প্রকল্প অনুমোদন পেত না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুই সিটি সমন্বয় করে প্রকল্প না নেওয়ায় এই বিনিয়োগ ভেস্তে যেতে পারে।’

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) উপপরিবহন প্রকৌশলী এ কে এম তৌফিকুল হাসান বলেন, ‘মেট্রো করিডর বাস্তবায়নসংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের একটি স্টাডির কাজে আমাকে যুক্ত করা হয়েছিল। ওই কাজের যারা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, তারা কয়েকবার আমার সঙ্গে সভা করেছে। আমি তাদের প্রশ্ন করেছি, মেট্রো করিডর কেন আংশিক বাস্তবায়ন করা হবে। এর কোনো সদুত্তর তারা দেননি।’

তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসির নেতৃত্বে মেট্রো করিডরে যে প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা খুবই ভালো প্রকল্প। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বলা হয়েছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button