Trending

৪০ বছর পেরিয়ে গেছে, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, চাঁদে মানুষ গেছে, সাইবেরিয়ার পরিবারটি জানতই না!

১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকরা সাইবেরিয়ার তাইগা বনের গভীরে পাঁচ সদস্যের এক পরিবারকে খুঁজে পান। তারা ১৯৩৬ সালে ধর্মীয় নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে গিয়ে লোকালয় থেকে ৪০ বছর সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকরা সাইবেরিয়ার তাইগা বনের গভীরে পাঁচ সদস্যের এক পরিবারকে খুঁজে পান। তারা ১৯৩৬ সালে ধর্মীয় নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে গিয়ে লোকালয় থেকে ৪০ বছর সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

সাইবেরিয়ার গ্রীষ্মকাল দীর্ঘস্থায়ী নয়। মে মাস পর্যন্ত এই অঞ্চলে তুষার পড়ে এবং আবার সেপ্টেম্বর মাসে ঠান্ডা আবহাওয়া ফিরে আসে। তখন তাইগা বন [বোরিয়াল বন নামেও পরিচিত] যেন একটি নির্জনতার জীবন্ত চিত্রে পরিণত হয়।

হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত পাইন ও বার্চ গাছের বন, ঘুমন্ত ভালুক এবং ক্ষুধার্ত নেকড়ের বিচরণ, খাড়া পাহাড়, উপত্যকায় বয়ে চলা সাদা পানির নদী এবং হাজার হাজার মাইলজুড়ে বরফাচ্ছন্ন জলাভূমি– এই বন পৃথিবীর শেষ এবং বৃহত্তম অরণ্যগুলোর একটি। এটি রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চল থেকে শুরু করে মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণে এবং ইউরাল পর্বত থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত, যেন লক্ষ লক্ষ বর্গমাইলের জনবসতিহীন এক শূন্যতা।

তবে যখন গরমের দিন আসে, তখন তাইগার চিত্র পালটে যায়। কয়েক মাসের জন্য বনটিকে যেন কিছুটা জীবন্ত মনে হয়। তখনই মানুষ এই গোপন পৃথিবীকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। তবে জমি থেকে নয়, কারণ তাইগা অভিযাত্রীদের পুরো একটি দলকে গিলে ফেলতে পারে। তাই আকাশ থেকে এই বন দেখা সবচেয়ে নিরাপদ।

সাইবেরিয়া রাশিয়ার অধিকাংশ তেল এবং খনিজ সম্পদের উৎস। বছরের পর বছর এর সবচেয়ে দূরবর্তী জায়গাগুলোতেও তেল অনুসন্ধানকারী এবং জরিপকারীরা যেতেন। তারা বনাঞ্চলের ক্যাম্পগুলোতে যেতেন, যেখানে সম্পদ আহরণের কাজ চলত।

এভাবেই ১৯৭৮ সালের গ্রীষ্মে বনটির দক্ষিণের এক বিচ্ছিন্ন অংশে একটি হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। এটি ভূতাত্ত্বিকদের একটি দলকে নামানোর জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজছিল। হেলিকপ্টারটি মঙ্গোলিয়ার সীমান্ত থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে আবাকান নদীর একটি বেনামি শাখার ঘন বনে অবতরণ করার চেষ্টা করে। নদীটি বিপজ্জনক ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। উপত্যকার দেয়ালগুলো সরু ছিল, কিছু জায়গায় প্রায় খাড়া। আর পাইন ও বার্চ গাছগুলো এত ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, হেলিকপ্টারটি নামানোর মতো কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের কাচের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে অবতরণের জায়গা খুঁজছিলেন পাইলট। হঠাৎ তিনি যা দেখলেন, তা সেখানে থাকার কথা নয়। পাহাড়ের ঢালে একটি খোলা জায়গা, পাইন ও লার্চ গাছের মাঝে বেরিয়ে আছে। সেখানে লম্বা কালো রেখার মতো দাগ দেখা যাচ্ছিল। বিভ্রান্ত হেলিকপ্টার দলের সদস্যরা কয়েকবার জায়গাটি ঘিরে চক্কর দেন। শেষে তারা বাধ্য হয়ে মেনে নেন, এটি মানুষের বসতির চিহ্ন– একটি বাগান, খোলা জায়গায় যেটি দেখে অনেক পুরোনো বলে মনে হচ্ছিল।

এটি ছিল এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। সেই পাহাড় ছিল নিকটতম বসতি থেকে ১৫০ মাইল দূরে। এই এলাকা আগে কখনোই কেউ অন্বেষণ করেনি। এই এলাকায় কেউ বসবাস করছে, এমন কোনো তথ্য সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের কাছেও ছিল না।

লোহা খুঁজতে পাঠানো চারজন বিজ্ঞানীকে পাইলটদের এই পর্যবেক্ষণের কথা জানানো হয়। তারা এতে বিভ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। রুশ সাংবাদিক ভাসিলি পেসকভ তার বই ‘লস্ট ইন দ্য তাইগা: ওয়ান রাশিয়ান ফ্যামিলি’জ ফিফটি-ইয়ার স্ট্রাগল ফর সারভাইভাল অ্যান্ড রিলিজিয়াস ফ্রিডম ইন দ্য সাইবেরিয়ান উইল্ডারনেস’–এ লিখেছেন, “তাইগায় বুনো পশুর চেয়ে অপরিচিত মানুষের মুখোমুখি হওয়া বেশি বিপজ্জনক।”

লিকভ পরিবার সাইবেরিয়ার তাইগার দূর্গম অঞ্চলে ৪০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছে। তারা সম্পূর্ণ একা ছিল। সবচেয়ে কাছের মানুষের বসতি থেকে তাদের দূরত্ব ছিল ১৫০ মাইলেরও বেশি। ছবি: আমজানিটা

বিজ্ঞানীরা নিজেদের অস্থায়ী ঘাঁটিতে দশ মাইল দূরে অপেক্ষা না করে, তদন্ত করতে যান। দলের নেতা ভূতাত্ত্বিক গালিনা পিসমেনস্কায়া জানান, “আমরা এক সুন্দর দিন বেছে নিয়েছিলাম এবং সম্ভাব্য বন্ধুদের জন্য উপহার নিয়েছিলাম।” তবে তিনি বলেন, “পাশে ঝোলানো পিস্তলটি ঠিকঠাক আছে কি না, সেটা দেখে নিয়েছিলাম।”

অনুপ্রবেশকারীরা পাহাড়ে উঠে পাইলটদের দেখানো স্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে তারা মানুষের চিহ্ন দেখতে পেলেন। একটি মাটির রাস্তা, একটি লাঠি, একটি গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি সেতু এবং শেষে একটি ছোট ঘর। ঘরটিতে বার্চের বাকলের পাত্রে শুকনো আলুর টুকরো রাখা ছিল। পিসমেনস্কায়া পেস্কভকে বলেছিলেন:

জলের ধার ঘেঁষে একটি বাসস্থান ছিল। সময় আর বৃষ্টিতে কালো হয়ে যাওয়া কুটিরটি চারপাশে তাইগার জঞ্জালে ভরা– বাকল, খুঁটি, তক্তা। যদি ব্যাকপ্যাকের পকেটের মতো ছোট জানালাটি না থাকত, তাহলে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো, সেখানে মানুষ থাকে। কিন্তু তারা থাকত, তাতে সন্দেহ ছিল না। আমাদের আগমন নজরে পড়েছিল, তা বুঝতে পারছিলাম।

নীচু দরজাটি কেঁপে উঠল আর ভেতর থেকে রূপকথার গল্পের মতো দেখতে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। খালি পায়ে। বস্তার কাপড় দিয়ে সেলাই করা জামা পরা, যা বারবার মেরামত করা হয়েছে। একই কাপড়ের প্যাঁচানো প্যান্ট পরা। তার দাড়ি অগোছালো। চুল এলোমেলো। তিনি ভীত ও সতর্ক ছিলেন। আমাদের কিছু বলা দরকার ছিল, তাই আমি বললাম, “শুভেচ্ছা নেবেন দাদু! আমরা আপনাকে দেখতে এসেছি।”

বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন না। শেষে নরম, অনিশ্চিত কণ্ঠে বললেন, “যেহেতু এত দূর এসেছেন, ভেতরে আসুন।”

যখন ভূতাত্ত্বিকরা কেবিনে ঢুকলেন, তারা যা দেখলেন, তা মধ্যযুগীয় কিছু মনে হচ্ছিল। জড়ো করা বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই ঘর। এটি ছিল আসলে মাটির গর্তের মতো– নীচু, কালো কালিতে ঢাকা কাঠের কুটির। এটি ছিল, ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো। মেঝে ছিল আলুর খোসা আর পাইন বাদামের খোসা দিয়ে ঢাকা। পেসকভ এই বর্ণনা লেখেন।

কম আলোতে চারদিকে তাকিয়ে দেখা গেল, পুরো ঘরটি একটিমাত্র কক্ষ। এটি ছিল খুব ছোট, স্যাঁতসেঁতে আর ভীষণ নোংরা। ভেঙে পড়া কাঠের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল এটি। আর অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, এখানে পাঁচজনের একটি পরিবার বাস করত। পিসমেনস্কায়া লেখেন:

“হঠাৎই নীরবতা ভেঙে কান্না আর বিলাপ শুরু হলো। তখন আমরা দুজন নারীর অবয়ব দেখতে পেলাম। একজন উন্মাদের মতো প্রার্থনা করছিলেন, বলছিলেন, ‘এ আমাদের পাপের শাস্তি, আমাদের পাপ।’ আরেকজন কাঠের খুঁটির আড়ালে দাঁড়ানো ছিলেন। ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়লেন। জানালা দিয়ে আসা আলোয় তার বড় বড় ভয়ার্ত চোখ দেখা যাচ্ছিল। আমরা বুঝতে পারলাম, এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে।”

পিসমেনস্কায়ার নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা তাড়াহুড়া করে কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন। তারা কয়েক গজ দূরে গিয়ে প্রয়োজনীয় খাবার বের করে খেতে শুরু করলেন। প্রায় আধ ঘণ্টা পর কুটিরের দরজা খুলে গেল। বৃদ্ধ এবং তার দুই মেয়ে বের হয়ে এলেন। তাদের আতঙ্ক কমেছে, তবে ভয় এখনও স্পষ্ট। এবার তারা কৌতূহলী।

তিন অচেনা ব্যক্তি ধীরে ধীরে কাছে এলেন এবং বসে পড়লেন। তাদের কিছু খাবার দেওয়া হলে, তারা সবকিছু– জ্যাম, চা, রুটি নিতে অস্বীকার করলেন। বললেন, “আমাদের এটা খেতে মানা!”

পিসমেনস্কায়া জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কখনো রুটি খেয়েছেন?” বৃদ্ধ বললেন, “আমি খেয়েছি। কিন্তু তারা কখনো খায়নি। তারা রুটি দেখেওনি।” অন্তত তার কথা কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল। মেয়েদের ভাষা ছিল বিচ্ছিন্ন জীবনের কারণে বিকৃত।

পিসমেনস্কায়া বলেছিলেন, “যখন দুই বোন একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিল, সেটা শোনাচ্ছিল ধীর, অস্পষ্ট গুঞ্জনের মতো।”

পিটার দ্য গ্রেটের ১৮শ শতকের শুরুতে রাশিয়াকে আধুনিক করার প্রচেষ্টা, বিশেষ করে দাড়ি না রাখার প্রচারণা কার্প লিকভ এবং পুরোনো বিশ্বাসীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। ছবি: ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি আর্কাইভ

ধীরে ধীরে, একাধিক পরিদর্শনে, পরিবারের পূর্ণ ইতিহাস প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। বুড়ো মানুষের নাম ছিল কার্প ওসিপোভিচ লিকভ। তিনি ছিলেন এক পুরোনো বিশ্বাসী, যারা ১৭ শতকের পর থেকে পরিবর্তনহীনভাবে রুশ অর্থডক্স ধর্মে পূজা করতেন। পুরোনো বিশ্বাসীরা পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে নির্যাতিত হচ্ছিলেন। লিকভ তা এমনভাবে বলেছিলেন, যেন গতকালই তা ঘটেছিল।

তার জন্য, পিটার ছিল একজন ব্যক্তিগত শত্রু এবং “মানবরূপী অ্যান্টিক্রাইস্ট”। এই শতাব্দী প্রাচীন ঘৃণা আরও সাম্প্রতিক অসন্তোষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। পিটার দ্য গ্রেটের ১৮শ শতকের শুরুতে রাশিয়াকে আধুনিক করার প্রচেষ্টা, বিশেষ করে দাড়ি না রাখার প্রচারণা কার্প লিকভ এবং পুরোনো বিশ্বাসীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। কার্প প্রায়ই ১৯০০ সালের কাছাকাছি এক ব্যবসায়ীকে নিয়ে অভিযোগ করতেন, যে পুরানো বিশ্বাসীদের ২৬ পুড [পুরোনো রাশিয়ান পরিমাপের একক] লবণ উপহার দেয়নি। যখন ভূতাত্ত্বিকরা তাকে কী কী ঘটেছে তা জানাচ্ছিলেন, তিনি বর্তমান ঘটনার ব্যাপারে তার মতামত গঠন করতে একই দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করতেন:

যে ঘটনাগুলো বিশ্বের সবাইকে উত্তেজিত করেছিল, তা লিকভদের জানা ছিল না। লিকভরা কোনো বিখ্যাত নাম জানতেন না এবং পূর্বের যুদ্ধ সম্পর্কে তারা খুব অস্পষ্ট কিছু শুনেছিলেন। যখন ভূতাত্ত্বিকরা “প্রথম বিশ্বযুদ্ধ” নিয়ে কার্প ওসিপোভিচের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি মাথা নাড়িয়ে বললেন: “এটা কি, দ্বিতীয়বার, আর সব সময়ই জার্মানরা। পিটারকে অভিশাপ দাও। সে তাদের সঙ্গে মিশেছিল। এটা এমনই।”

লিকভ পরিবারের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল যখন বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসে। সোভিয়েতদের অধীনে, নির্যাতন থেকে পালিয়ে সাইবেরিয়ায় আশ্রয় নেওয়া বিচ্ছিন্ন পুরানো বিশ্বাসী সম্প্রদায়গুলো আরও গভীরভাবে সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করেছিল। ১৯৩০-এর দশকের দমন-পীড়ন বা নিধন অভিযানের সময়ে যখন খ্রিস্টধর্মই আক্রমণের মুখে ছিল, একজন কমিউনিস্ট টহলদার লিকভের ভাইকে তাদের গ্রাম থেকে কিছু দূরে গুলি করে হত্যা করেছিল। তখন লিকভ পাশেই কাজ করছিলেন। তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় তার পরিবারকে তুলে নিয়ে বনে পালিয়ে যান।

১৯৮০ সালে একটি রুশ প্লেন থেকে তোলা লিকভদের আবাস। ছবি: সংগৃহীত

১৯৩৬ সালের কথা। তখন লিকভ পরিবারে চারজন সদস্য ছিল– কার্প, তার স্ত্রী আকুলিনা, তাদের ছেলে সাভিন (যার বয়স তখন ছিল প্রায় ৯ বছর) এবং মেয়ে নাটালিয়া (যার বয়স ছিল মাত্র ২ বছর)। নিজেদের সামান্য সামগ্রী এবং কিছু বীজ নিয়ে তারা তাইগার গভীরে আশ্রয় নিয়েছিল। একের পর এক সাধারণ ঘর তৈরি করে তারা এই নির্জন জায়গায় পৌঁছান।

জঙ্গলে থাকার সময় তাদের আরও দুটি সন্তান জন্ম নেয়– ১৯৪০ সালে দিমিত্রি এবং ১৯৪৪ সালে আগাফিয়া। বাইরের জগতের সম্পর্কে তাদের যা জানা ছিল, তা সবই বাবা-মায়ের গল্প থেকে শোনা। পরিবারটির প্রধান বিনোদন ছিল, তাদের স্বপ্ন নিয়ে গল্প করা।

লিকভ পরিবারের শিশুরা জানত, শহর নামে জায়গা আছে, যেখানে মানুষ উঁচু ভবনে গাদাগাদি করে থাকে। তারা শুনেছিল, রাশিয়া ছাড়াও অন্য দেশ আছে। কিন্তু এই ধারণাগুলো তাদের কাছে ছিল কেবল কল্পনার মতো। তাদের একমাত্র পড়ার উপকরণ ছিল, প্রার্থনার বই এবং একটি পুরোনো পারিবারিক বাইবেল।

আকুলিনা তাদের পড়া-লেখা শিখিয়েছিলেন, বার্চ গাছের কঞ্চি আর হানিসাকল ফুলের রস দিয়ে কলম ও কালি তৈরি করে। পরে আগাফিয়া যখন ভূতাত্ত্বিকদের টিভিতে ঘোড়ার ভিডিও দেখে, তখন সে চিনতে পারে। “একটি ঘোড়া!” সে চিৎকার করে বলে, “বাবা, একটি ঘোড়া!”

তাদের বিচ্ছিন্ন জীবন কেমন ছিল তা কল্পনা করা কঠিন। তবে তাদের জীবনের কঠোরতা সহজেই বোঝা যায়। লিকভদের বাড়িতে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। পেস্কভ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, “আমরা ২৫০ কিলোমিটার (প্রায় ১৫৫ মাইল) হেঁটেছি, কোথাও কোনো মানুষের বাড়ি দেখিনি।”

বিচ্ছিন্নতার কারণে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। নিজেদের সামান্য সম্পদের ওপর নির্ভর করে লিকভরা তাইগায় সংগ্রাম করেছিল। তারা জুতার বদলে বার্চ গাছের ছাল দিয়ে গ্যালশ বানিয়েছে। পোশাক বারবার সেলাই করে ব্যবহার করত। যখন সেগুলো আর ব্যবহারের উপযুক্ত থাকত না, তখন তারা বীজ থেকে জন্মানো শণ দিয়ে নতুন কাপড় তৈরি করত।

লিকভ পরিবার নিজ হাতে তৈরি কাঠের কুঁড়েঘরে বাস করত। ছবি: সংগৃহীত

লিকভ পরিবার একটি অতি সাধারণ চরকা এবং আশ্চর্যজনকভাবে উলের সুতো নিয়ে তাইগায় গিয়েছিল। তাদের কাছে ছিল দুটি কেটলি, যা বহু বছর ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কেটলিগুলো নষ্ট হয়ে গেলে, তারা বার্চ গাছের ছাল দিয়ে নতুন কেটলি তৈরি করে। এই কেটলিগুলো আগুনে ব্যবহার করা যেত না, তাই রান্না করা কঠিন হয়ে পড়ে।

যখন লিকভ পরিবারকে আবিষ্কার করা হয়, তখন তাদের প্রধান খাবার ছিল– রাইয়ের গুঁড়া মেশানো আলুর পিঠা এবং শণ বীজ।

পেস্কভ লিখেছেন, “কিছু ক্ষেত্রে তাইগা অনেক কিছু দিত। বাসস্থানের পাশে ছিল ঠান্ডা ও পরিষ্কার একটি ঝরনা। লার্চ, স্প্রুস, পাইন ও বার্চ গাছের জঙ্গল থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যেত। হাতের কাছেই ছিল বিলবেরি আর রাসবেরি। জ্বালানি কাঠও ছিল আর পাইন গাছের বাদাম পড়ত ছাদের ওপর।”

তবু লিকভ পরিবার সবসময় ক্ষুধার সমস্যায় ভুগতো। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে, দিমিত্রি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তারা প্রথম প্রাণীর মাংস ও চামড়ার জন্য ফাঁদ পেতে শিকার শুরু করে। তাদের কাছে বন্দুক বা তীর-ধনুক ছিল না।

তারা শুধু গর্ত খুঁড়ে ফাঁদ পাতত বা পাহাড়জুড়ে পশুদের ধাওয়া করত, যতক্ষণ না তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ত। দিমিত্রি “অসাধারণ সহ্যশক্তি” অর্জন করেছিল। সে শীতে খালি পায়ে শিকার করত এবং কখনো কখনো কাঁধে একটি ছোট এলক (বৃহৎ হরিণ) নিয়ে দিনের পর দিন হাঁটত।

তবে বেশির ভাগ সময় মাংস পাওয়া যেত না। তাদের খাদ্য তালিকা আরও একঘেয়ে হয়ে উঠত। বন্য প্রাণীরা তাদের গাজরের ফসল নষ্ট করে দিত। আগাফিয়া ১৯৫০-এর দশকের শেষদিককার সময়টিকে “ক্ষুধার বছর” বলে মনে করত। সে বলেছিল: 

“আমরা রৌওয়ানবেরি পাতা, শিকড়, ঘাস, মাশরুম, আলুর কুঁড়ি এবং ছাল খেতাম। সব সময় আমরা ক্ষুধার্ত থাকতাম। প্রতি বছর একটি সভা আয়োজিত হত, যাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো সব কিছু খেয়ে ফেলা হবে না কি কিছু বীজের জন্য রেখে দেওয়া হবে।”

এই পরিস্থিতিতে অনাহার একটি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল এবং ১৯৬০ সালে জুন মাসে তুষারপাত হয়। কঠিন তুষারপাতে তাদের বাগানে থাকা সব কিছু মরে যায় এবং বসন্তে পরিবারটি চামড়ার জুতো, ছাল ও তৃণ খেতে বাধ্য হয়। আকুলিনা তার সন্তানদের খাবার খাওয়ানোর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন এবং ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি অনাহারে মারা যান।

বাকি পরিবারটি এক বিস্ময় হিসেবে বেঁচে যায়। তাদের মটরের গাছের মধ্যে একটি একক রাইয়ের দানা গজায়। লিকভ পরিবার গাছটির চারপাশে একটি বেড়া তৈরি করে এবং ইঁদুর ও কাঠবিড়ালিকে তাড়ানোর জন্য দিন-রাত এটি পাহারা দেয়। ফসল তোলার সময়, একমাত্র শীষটি ১৮টি দানা দেয় আর এই দানাগুলো থেকে তারা ধৈর্যের সাথে তাদের রাইয়ের ফসল আবার ফলাতে সক্ষম হয়।

রুশ সংবাদপত্রের তোলা একটি ছবিতে কার্প লিকোভ (বাম থেকে দ্বিতীয়) দিমিত্রি ও আগাফিয়ার সঙ্গে একজন সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিক। ছবি: সংগৃহীত

সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকরা লিকভ পরিবারকে জানার পর বুঝতে পারেন, তারা তাদের দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তাকে কম মূল্যায়ন করেছিলেন। বুড়ো কার্প সাধারণত বিজ্ঞানীদের ক্যাম্প থেকে আনা নতুন আবিষ্কারগুলোতে আনন্দিত হতেন এবং যদিও তিনি চাঁদে মানুষ পা রেখেছে তা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করতেন, তিনি স্যাটেলাইটের ধারণাটি দ্রুত গ্রহণ করেছিলেন।

লিকভরা ১৯৫০-এর দশকেই স্যাটেলাইটগুলো লক্ষ্য করেছিলেন, যখন “তারারা আকাশে দ্রুত চলতে শুরু করেছিল।” কার্প নিজে একটি তত্ত্ব তৈরি করেন এই ব্যাপারে: “মানুষ কিছু চিন্তা করেছে এবং এমন আগুন পাঠাচ্ছে যা তারার মতো দেখায়।”

“যা তাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছিল,” পেস্কভ রেকর্ড করেছেন, “তা ছিল একটি স্বচ্ছ সেলোফেন প্যাকেট। ‘হে ঈশ্বর, তারা ভাবল—এটা কাচ, কিন্তু এটা কুঁচকানো যায়!'”

জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত [যখন তার বয়স ৮০-এর দিকে ছিল] কার্প পরিবারে প্রধান হিসেবে তার অবস্থান অটুট রেখেছিলেন। তার বড় সন্তান স্যাভিন ধর্মীয় বিষয়ে পরিবারের অটল বিচারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

“স্যাভিন তার বিশ্বাসে দৃঢ় ছিল, কিন্তু সে কঠোর মানুষ ছিল,” কার্প বলেছিলেন। তিনি (কার্প) সম্ভবত চিন্তা করতেন, তার মৃত্যুর পর স্যাভিন যদি পরিবারটির নেতৃত্ব নেন, তবে কী হবে।

নিশ্চিতভাবেই বড় ছেলে নাটালিয়ার কাছ থেকে খুব একটা বাধা পেত না, যিনি সবসময় তার মা হয়ে রান্না, সেলাই ও নার্সের কাজ করার চেষ্টা করতেন। অন্যদিকে, দুই ছোট সন্তান পরিবর্তন ও নতুনত্বের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল।

“আগাফিয়ার মধ্যে উগ্রতা খুব বেশি ছিল না,” পেস্কভ লিখেছেন এবং সময়ের সাথে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, লিকভ পরিবারের ছোট সদস্যের মধ্যে “হাস্যরস ও বিদ্রুপের অনুভূতি ছিল এবং নিজেকে হাস্যকর বানানোর ক্ষমতা রাখত।”

আগাফিয়ার ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি স্যাভিনকে সময় সম্পর্কে খেয়াল রাখতে সাহায্য করতেন, এমনকি তাদের কাছে কোনো ক্যালেন্ডার না থাকার পরেও। কঠিন কাজের প্রতি তার কোনো অবজ্ঞা ছিল না। সে শরৎকালে নিজের হাতে নতুন মাটি খুঁড়ত এবং সূর্যাস্তের পর চাঁদের আলোতে কাজ করত।

পেস্কভ বিস্মিত হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি রাতের বেলায় একা বনে থাকতে ভয় পান কি না? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “ভয়ের কিছু নেই।”

লিকভ পরিবারের মধ্যে, সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকদের প্রিয় ছিলেন দিমিত্রি। তিনি তাইগার সমস্ত মেজাজ জানতেন। তিনি ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে আগ্রহী এবং সম্ভবত সবচেয়ে দূরদর্শী সদস্য। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পরিবারটির চুলা তৈরি করেছিলেন এবং সমস্ত বার্চ-ছালের বালতি, যা তারা খাবার সংরক্ষণে ব্যবহার করতেন সেগুলো তৈরি করেছিলেন।

অবিশ্বাস্যভাবে, তিনি ছিলেন বিজ্ঞানীদের প্রযুক্তিতে সবচেয়ে মুগ্ধ। যখন সম্পর্ক উন্নত করে লিকভদের সোভিয়েত ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য রাজি করানো সম্ভব হয়েছিল, দিমিত্রি সেখানে অনেক সময় কাটাতেন। তিনি ছোট স মিলটি দেখতেন এবং কত সহজে একটি বৃত্তাকার চাকা ও লাথ মেশিন দিয়ে কাঠ কাটা যায়, তা দেখে অবাক হতেন।

“এটা বোঝা কঠিন কিছু নয়,” পেস্কভ লিখেছেন। “যে লগটি [বড় কাঠ] দিমিত্রি এক বা দুই দিন সময় নিয়েছিল তোলার জন্য, তা তার চোখের সামনে সুন্দর, সমান বোর্ডে পরিণত হলো। দিমিত্রি তার হাতে বোর্ডগুলো অনুভব করে বলেছিল: ‘বাহ!'”

কার্প লিকভ একটি দীর্ঘ এবং হারানো যুদ্ধ করেছিলেন নিজেকে ধরে রাখার জন্য, যাতে এই আধুনিকতা থেকে দূরে থাকা যায়। যখন তারা প্রথম সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকদের সাথে পরিচিত হন, পরিবারটি শুধু একটি উপহার গ্রহণ করত এবং সেটি ছিল লবণ। (কার্প বলেছিলেন, চার দশক লবণ ছাড়া বসবাস করা “সত্যিকারের যন্ত্রণার মতো ছিল।”)

কিন্তু সময়ের সাথে তারা আরও অনেক কিছু গ্রহণ করতে শুরু করেন। তারা ভূতাত্ত্বিকদের মধ্যে একজন ড্রিলার ইরোফেই সেদভের [তাদের বিশেষ বন্ধু] সাহায্যকে স্বাগত জানায়। তিনি তার অবসর সময়ের অনেকটা অংশ তাদের ফসল বপন ও সংগ্রহে সাহায্য করতেন।

অবশেষে তারা কম্বল, উলের মোজা, শস্য এমনকি একটি ফ্ল্যাশলাইটও গ্রহণ করেছিল। একবার যখন আগাফিয়াকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেন সে ম্যাচ গ্রহণ না করে ব্যাটারিচালিত ফ্ল্যাশলাইট নিয়েছিল, তখন তিনি তার “উত্তর জানতেন না,” পেস্কভ লিখেছেন। “তিনি শুধু নিশ্চিত করেছিলেন যে ম্যাচ সত্যিই একটি পাপ।” তিনি লেখেন:

ক্যাম্পে তারা বসে টেলিভিশন দেখত। কার্প পর্দার ঠিক সামনে বসতেন। আগাফিয়া দেখতেন, দরজার পেছন থেকে তার মাথা বের করে। সে তার পাপটি [তাদের কাছে টেলিভিশন দেখা ছিল পাপ] তাড়াতাড়ি প্রার্থনা করে মুছে ফেলতে চেষ্টা করত, অনেকটা ফিসফিস করে, বুকে ক্রস চিহ্ন দিয়ে এবং আবার তার মাথা বের করে টেলিভিশন দেখতেন। বুড়ো মানুষটি পরবর্তী সময়ে প্রার্থনা করতেন, আন্তরিকভাবে এবং একসাথে।

লিকভ পরিবারের অদ্ভুত গল্পের সম্ভবত সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হলো, তারা যখন বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছিল, তখন তাদের অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। ১৯৮১ সালের শরতে, চার সন্তানের মধ্যে তিনজন মারা যায়।

পেস্কভের মতে, তাদের মৃত্যু [কিছু মানুষের অনুমান] এমন রোগের সংক্রমণে হয়েছে, যেসবের জন্য তাদের কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল না। স্যাভিন এবং নাটালিয়া উভয়ে কিডনি ফেইলারে ভুগছিলেন, যা সম্ভবত তাদের কঠিন খাদ্য খাওয়ার ফলে হয়েছে। কিন্তু দিমিত্রি নিউমোনিয়ায় মারা যান, যা সম্ভবত তার নতুন বন্ধুদের থেকে পাওয়া সংক্রমণের ফলে হয়েছিল।

লিকভদের কবর। ছবি: সংগৃহীত

দিমিত্রির মৃত্যু ভূতাত্ত্বিকদের অনেক নাড়া দিয়েছিল। তারা তাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছিলেন। তারা হেলিকপ্টার ডেকে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু দিমিত্রি চরম অসুস্থ অবস্থায় তার পরিবার বা তার সারা জীবনের পালনকৃত ধর্ম ছাড়তে রাজি হননি। “আমাদের এটা অনুমতি নেই,” তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ফিসফিস করে বলেছিলেন। “একজন মানুষ কতদিন বাঁচবে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।”

যখন তিনজন লিকভকে সমাহিত করা হয়, ভূতাত্ত্বিকরা কার্প ও আগাফিয়াকে বন ছেড়ে তাদের যেসব আত্মীয় হত্যাযজ্ঞের সময় বেঁচে গিয়েছিল এবং পুরানো গ্রামে এখনো বসবাস করছিল, তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা সেই সে প্রস্তাব শোনেননি।

আগাফিয়া তখন একটি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। সোভিয়েত সরকার তাকে দেশে ভ্রমণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল এবং তিনি যেতে রাজি হন। তার বাবা থেকে যান। কিন্তু আগাফিয়া একমাস রাস্তায় কাটান এবং যা তিনি কখনু দেখেননি তা দেখে সময় কাটান। যখন ভ্রমণ শেষ হয়,তখন তিনি তার পুরানো জীবনে ফিরে যান।

২০১৩ সালে ভাইসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে  আগাফিয়া বলেছিলেন, “বাইরের দুনিয়া অনেক ভয়ের। এখানে শ্বাস নেওয়া যায় না। সব জায়গায় গাড়ি। এখানে বিশুদ্ধ বাতাস নেই। প্রতিটি গাড়ি চলে যাওয়ার পর অনেক দূষিত কণা বাতাসে রেখে যায়। আপনার আর কোনো উপায় নেই, শুধু বাড়িতেই থাকতে হয়।”

আগাফিয়া লিকভ ২০১৬ সালে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। ছবি: এপি

আগাফিয়ার সেই সফরের কিছু সময় পর ১৯৮৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কার্প লিকভ ঘুমের মধ্যে মারা যান, তার স্ত্রীর মৃত্যুর ২৭ বছর পর। আগাফিয়া তাকে ভূতাত্ত্বিকদের সাহায্যে পাহাড়ের ঢালে সমাহিত করেন। তারপর ঘরে ফিরে যান।

“প্রভু ব্যবস্থা করবেন, আমি এখানে থাকব,” তিনি বলেছিলেন এবং তিনি সত্যিই সেখানে ছিলেন।

লেখক ইজাবেল কোলগেট তার বই ‘পেলিকান ইন দ্য উইল্ডারনেস: হার্মিটস, সোলিটারিস এন্ড রিকলুসেস’-এ লিখেছিলেন, “তাইগা তাকে (আগাফিয়া) পুনরায় গ্রহণ করেছিল। তিনি অনুভব করেছিলেন, এটি তার বাড়ি।”

৩০ বছরেরও বেশি সময় পর, এই তাইগার সন্তান এখনও বনে বেঁচে আছেন। তবে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় [এ বছর তার বয়স ৮০ হয়েছে] তিনি আরও বেশি সাহায্য গ্রহণ করা শুরু করেছেন।

সম্প্রতি, তার সাহায্যের অনেকটাই আসে রুশ বিলিয়নিয়ার ওলেগ ডেরিপাসকার কাছ থেকে। তিনি কয়েক বছর আগে আগাফিয়ার জন্য একটি নতুন কাঠের কটেজ বানানোর খরচ বহন করেছিলেন।

আগাফিয়া একটি স্যাটেলাইট ফোনও পেয়েছেন, যা তিনি প্রতিদিন ব্যবহার করেন।  স্বেচ্ছাসেবীরা নিয়মিতভাবে তার একেবারে বিচ্ছিন্ন বাড়িতে গিয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করেন এবং তাকে দৈনন্দিন কাজকর্মে সাহায্য করেন, বিশেষ করে শীতকালীন সময়ে।

কার্পের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন সেদভ বলেছিলেন, “আগাফিয়া চলে যাবেন না। কিন্তু আমাদের তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে।”

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর ভূতাত্ত্বিকদের দল যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন সেদভ পেছনে ফিরে যা দেখেছিলেন, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন:

“আমি পিছন ফিরে আগাফিয়াকে বিদায় দিতে তাকালাম। সে নদীর তীরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন একটি ভাস্কর্য। সে কাঁদছিল না। সে মাথা নেড়ে বলল: ‘চলে যাও, চলে যাও।’ আমরা আরেক কিলোমিটার এগিয়ে গেলাম এবং আমি ফিরে তাকালাম। সে তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল।”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button