Bangladesh

৪৪.৭% মানুষ মনে করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ভালো করছে না

ভয়েস অফ আমেরিকার এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষ মনে করেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ পারফর্ম করছে অথবা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে।

জরিপে দেখা গেছে, ৪৪.৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন চাল, মাছ, সবজি, ডিম, মাংস, তেল-এর মত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ পারফর্ম করেছে। এক-চতুর্থাংশের কম উত্তরদাতা – ২৩.৮ শতাংশ – মনে করেন বর্তমান সরকার আগের সরকারের তুলনায় ভাল করছে।

প্রায় এক-তৃতীয়াংশ – ৩০.৮ শতাংশ – মনে করেন পরিস্থিতি আগে যা ছিল তাই আছে।

জরিপে ১,০০০ উত্তরদাতাকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলের সাথে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের তুলনা করতে বলা হয়।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে নারী এবং পুরুষ উত্তরদাতাদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।

পুরুষ উত্তরদাতদের ৩১.৩ শতাংশ মনে করেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের চেয়ে ভাল করছে। অন্যদিকে, নারী উত্তরদাতাদের মাত্র ১৬.৩ শতাংশ মনে করেন বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে ভাল করছে।

নারীদের একটি বড় অংশ – ৪১.২ শতাংশ – মনে করেন পরিস্থিতি আগে যা ছিল তাই আছে, কিন্তু পুরুষ উত্তরদাতাদের মাত্র ২০.৩ শতাংশ তাই মনে করেন।

বাংলাদেশের জনতত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জরিপের ১,০০০ উত্তরদাতা বাছাই করা হয়। সেখানে সমান সংখ্যার নারী এবং পুরুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ৯২.৭ শতাংশ ছিলেন মুসলিম। উত্তরদাতাদের অর্ধেকের একটু বেশি ছিল ৩৪ বছর বয়সের নিচে এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহুরে মানুষ।

ভয়ানক আর্থিক চাপ

মিরপুরের বাসিন্দা হীরেন পণ্ডিত ঢাকায় এক বেসরকারি সংস্থায় প্রোগ্রাম কোঅরডিনেটর হিসেবে কাজ করছেন। দুই ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া সন্তান সহ চারজনের পরিবারের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটছিল। কিন্তু ২০২৪ সাল তাঁর জীবনে নিয়ে এসেছে ভয়ানক আর্থিক চাপ।

“দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে আমরা দম বন্ধ করার মত অবস্থায় আছি,” হীরেন পণ্ডিত ভয়েস অফ আমেরিকাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন। “বাসা ভাড়া বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, যে জিনিস আগে ১৪০ টাকায় কেনা যেত সেটা এখন ১৭০ টাকায় কিনতে হয়।”

বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ’বছর জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৭২ শতাংশ। এই হার অক্টোবর মাসে এসে দাঁড়িয়েছে ১০.৮৭ শতাংশে। এর মধ্যে দেশে একটি গণঅভ্যুত্থান এবং সরকার পরিবর্তন হয়ে গেছে।

তবে মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০২৪ –এর জুলাই-এ সৃষ্টি হয় নি, যদিও সে মাসেই ছিল এ’পর্যন্ত বছরের সবচেয়ে উঁচু হার – ১১.৬৬ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ২০২০ বা ২০২১ সালে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠা-নামা করছিল। কিন্তু ২০২২ সালের মাঝা-মাঝি সময় থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে এবং ২০২৩ সাল তা ৯ শতাংশের উপরে, ১০ ছুঁই ছুঁই করছিল।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর বিশ্ব জ্বালানী বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, এবং তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর ফলে আমদানি-নির্ভর বাংলাদেশের জন্য আসে বড় ধাক্কা।

বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমে যায়, বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ কমতে থাকে এবং দেশের আমদানি করার সক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে।

অগাস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা নেয়ার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের উপর উর্ধমুখি চাপ অব্যাহত থাকে। সেপ্টেম্বর যদিও মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে, কিন্তু অক্টোবরে তা পুনরায় ১১ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন এখানে রাজনৈতিক এবং প্রাকৃতিক ঘটনাবলী প্রভাব ফেলেছে।

“বাংলাদেশে জুলাই-অগাস্ট-এর আন্দোলন এবং তার প্রেক্ষিতে সরকার পতনের ফলে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থাও প্রভাবিত হয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে,” বলছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর রিসার্চ ডিরেক্টর গোলাম মোয়াজ্জেম।

“একই সাথে দেশের বড় এলাকা জুড়ে পর পর দুটো বন্যা হয়েছে, যার ফলে চালের উৎপাদন, বিশেষ করে আমন এবং অন্যান্য শাক-সবজির উৎপাদনের উপর চাপ পড়েছে,” তিনি বলেন।

গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর দেশের অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে এবং সেবা খাতে কর্মসংস্থান এবং আয়ের উপর সম্ভবত নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে গোলাম মোয়াজ্জেমের ধারনা। যার ফলে তুলনামুলকভাবে কাজ কম, এবং বিশেষ করে যারা দৈনিক কাজ করে অ্যায় করেন, তাদের উপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেবার পর তারা মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষে বেশি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন চাল, আলু, চিনি, তেল, পিঁয়াজ ইত্যাদির উপর আমদানি কর কমানো হয়েছে।

বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য এলসির মার্জিন ১০০ ভাগ থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে, যাতে আমদানিকারক সহজে আমদানি করতে পারে। একই সাথে বাজার মনিটর করা হচ্ছে, সরবরাহ চেইনে যারা বড় ভূমিকা রাখেন তাদের উপর নজরদারি করা হচ্ছে।

চাকুরীজীবীদের উপর চাপ

গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিসংখ্যান আগের তুলনায় আরও স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য হলেও, প্রশাসনের পদক্ষেপে কোন নতুনত্ব নেই।

“এই উদ্যোগগুলো আগের উদ্যোগগুলোর মতনই, আমি খুব নতুনত্ব দেখছি না। আমি খুব হতাশ, কারণ এ’পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি এবং সরবরাহ চেইনের ব্যবস্থাপনায় কোন গতিশীল উদ্যোগ এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি,“ তিনি বলেন।

মূল্যস্ফীতির এই ধাক্কা নির্দিষ্ট আয়ের চাকুরীজীবীদের উপর ভয়ানক প্রভাব ফেলছে। হীরেন পণ্ডিত বলছেন, আগে তাঁর মাসিক আয়ের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ খরচ হতো বাসা ভাড়া এবং খাদ্যদ্রব্যে। এখন তাঁকে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ খরচ করতে হচ্ছে।

“যা অ্যায় করছি তা সবই চলে যাচ্ছে, কোন সঞ্চয় হচ্ছে না এখন। আমাদের জন্য জীবনযাত্রা প্রায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে,” হীরেন পণ্ডিত বলেন।

বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সাথে পারিবারিক আয়ের কোন পরিবর্তন না হলে মধ্য বা নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে সখের জিনিস, এমনকি প্রয়োজনীয় জিনিসও বাদ দিয়ে চলতে হয়। হীরন পণ্ডিত কোন ব্যতিক্রম নয়।

“আগে যেমন মাঝে-মধ্যে ফলমূল খাওয়া হতো, এখন সেটা বন্ধ হয়েছে, খাসির মাংস হয়তো মাসে এক বা দু’দিন খাওয়া যেত, এগুলো বাদ দিতে হয়েছে,” তিনি বলেন।

ব্যাঙ্ক রেট বৃদ্ধি

দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক ২০২২ সাল থেকেই ব্যাঙ্ক রেট ধাপে ধাপে বাড়াচ্ছে, যাতে চাহিদা কমিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অক্টোবরের শেষে ব্যাঙ্ক সুদের হার আরেক দফা বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশে নেয়া হয়েছে।

এই পদক্ষেপগুলোর ফলাফল এখনো না দেখা গেলেও, গোলাম মোয়াজ্জেম এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে তিনি মনে করেন, কৃষি পণ্যের সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনায় মৌলিক কিছু সংস্কার না করা পর্যন্ত সমস্যা রয়েই যাবে।

“বাংলাদেশের বাজারের কাঠামোতে এক ধরনের অলিগোপলি বিরাজ করছে – অল্প কয়েকজন সরবরাহকারী এবং পুরো বাজারে থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণ, তারাই ঠিক করছেন কোন মূল্যে কাঁচামাল আসবে, কোন মূল্যে তারা কাকে বিতরণ করবেন,” তিনি বলেন।

তাঁর মতে, বাংলাদেশের কৃষি বাজার খুবই “স্পর্শকাতর এবং রাজনৈতিক,” কারণ বাজারের সরবরাহ সরকারকে রাজনৈতিক চাপের মধ্যে ফেলতে পারে।

“সেকারণে সরকারের তড়িৎ কিছু করে তড়িৎ কিছু ফল দেখানোর প্রবণতা থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে এই বাজারে সংস্কার করে ফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম,” তিনি বলেন।

বাজার সংস্কার প্রস্তাবগুলোর অন্যতম হচ্ছে, তিন বছরের জন্য পাঁচ বা ছয়টি পণ্য টার্গেট করে সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা ঠিক করার উদ্যোগ হাতে নেয়া।

“এগুলো যদি রেগুলারাইজ করা হয়, ফরমালাইজ করা হয়, যেমন রেজিস্টার্ড এজেন্ট ছাড়া আর কেউ মার্কেটে ঢুকতে পারবে না, ট্রান্স্যাকশন গুলা যদি ডিজিটাল করা হয় যাতে সবকিছু মনিটর করা যায়, তাহলে এক্ষেত্রে ফল পাওয়া যাবে,” তিনি বলেন। “কিন্তু এই ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor