Uncategorized

৫০ দিনেও থামানো যায়নি মণিপুরের দাঙ্গা

https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2023June/36-20230623145055-20230623195838.jpg

ভারতের মণিপুর রাজ্যের মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৩৯০ জন আহত হয়েছেন। তবুও থামছে না সহিংসতা। বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, মেইতেই সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরেই তফসিলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। আর এই দাবিটাই কুকি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের চলমান বিবাদের মূল উৎস। 

মে মাসের তিন থেকে ছয় তারিখ পর্যন্ত পুরো রাজ্যে ভয়াবহ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, মেইতেই আর কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরকে টার্গেট করেছিল। স্থানীয়রা বলছেন, মণিপুর এখন দু টুকরো হয়ে গেছে, যার একটা অংশে আছেন মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ, অন্য অংশে রয়েছেন কুকিরা। এই সহিংসতা এক, দুই বা চারদিনের নয়, টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে। পরিবার ধ্বংস হয়েছে, বাড়িঘর জ্বলে পুড়ে গেছে, উজাড় হয়ে গেছে গ্রামগঞ্জ।

জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কুকি সম্প্রদায় তফসিলি উপজাতির মর্যাদা পেয়েছে, অন্যদিকে মেইতেইরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ কুকিদের এলাকায় জমি কিনতে পারেন না, তাই তারা উপজাতির মর্যাদা চাইছেন। ২৮ লাখ জনসংখ্যার অধিকাংশই মেইতেই, যারা উপত্যকা অঞ্চলে বাস করেন। আর কুকি সম্প্রদায়ের আদি বাসস্থান ছিল চারটি পার্বত্য জেলায়।

মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সিং বলছেন, মণিপুরের মানুষের মধ্যে কখনই ধর্মীয় উগ্রতা ছিল না।কিন্তু সেটাও খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক এই সহিংসতায় দুই ধর্মাবলম্বীদেরই মৃত্যু আর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনও ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়ে ত্রাণ শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যেও কুকি আর মেইতেই, দুই সম্প্রদায়ের মানুষই আছেন। রাজধানী ইম্ফলের স্টেডিয়ামের পাশে একটি যুব হোস্টেল রয়েছে, যা এখন ত্রাণ শিবিরে রূপান্তরিত হয়েছে।

এদিকে গত কয়েক বছর ধরেই রাজ্যের রাজনীতিতে সাবেক মেইতেই হিন্দু রাজপরিবারের সদস্যদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সাবেক রাজপরিবারের বর্তমান কর্ণধার, মহারাজা লিশেম্বা সানজাওবা বর্তমানে বিজেপির রাজ্যসভার সংসদ সদস্য। সহিংসতার পর মাত্র একটি বিবৃতি জারি করে তিনি বলেন, সহিংসতা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং আলোচনাই প্রতিটি সমস্যার একমাত্র সমাধান। মণিপুরের ইতিহাসে এই প্রথম ধর্মীয় স্থানগুলো জাতিগত সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতায় চার্চ পুড়েছে, ভাঙ্গা হয়েছে মন্দিরও।

ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সভাপতি শারদা দেবী বলছেন, “চার্চ আর মন্দির দুই-ই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কুকি সম্প্রদায়ের প্রার্থনা করার স্থল গির্জাঘর এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের বাড়িতে যে উপাসনা-স্থল বানায়, উভয়েরই ক্ষতি করা হয়েছে। এটা আমাদের সকলের জন্যই দুঃখের বিষয়।” বিবিসির হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, রাজ্যে ২৫০টিরও বেশি চার্চ এবং প্রায় দুই হাজার কুকি সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে হামলা হয়েছে।

রাজ্যের গির্জাগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আমরা কুকি খ্রিস্টান লিডারস ফেলোশিপের প্রধান যাজক হাওকিপ থংখোস। তিনি বলেন, কুকি সম্প্রদায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গির্জাঘর, মানুষ এবং তাদের সম্পত্তিতে হামলাকারী জনতাকে থামায়নি সরকার, তাই এই সরকারের ওপরে আমরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। আর এটা জাতিগত সহিংসতা তো বটেই, একই সঙ্গে ভারতীয় হিন্দুদের খুশি করার জন্য গির্জার ওপরে এই হামলাগুলো চালানো হয়েছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১০০টি মন্দির আর হাজার দুয়েক মেইতেই বাড়িতে হামলা হয়েছে। মেইতেই সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠী ‘কোকোমি’-র মুখপাত্র কে ওথাবে বলেন, মণিপুরের কোনও সমস্যাই ধর্মীয় রূপ নেয় না, এবারেও বিষয়টি আরও বড় হয়ে ওঠার আগেই আটকানো গেছে। তার মতে, ২০০ টি চার্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু আপনার জানা উচিত যে আরও ৪০০ টি চার্চ এখনও অক্ষত রয়েছে। ধর্মীয় সহিংসতা হলে সেগুলো কি অক্ষত থাকত? এই সহিংসতার জন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারের চিন প্রদেশ থেকে পালিয়ে আসা কুকি জঙ্গিদেরও দায়ী করা হচ্ছে, যাদের কাছে রয়েছে প্রচুর আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।

কুকি স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের হোম সেক্রেটারি মাং খনসাইয় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সবাই তো কোথাও না কোথাও সংখ্যালঘু। আজ, শুধুমাত্র মণিপুরে থাকার কারণে আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে, আপনি কি শুধু মণিপুরেই সীমাবদ্ধ থাকবেন? আরও অনেক জায়গা আছে যেখানে তারাও আমাদের মতো একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে।

কেন্দ্রীয় সরকারকে এর অবসান ঘটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। অপরদিকে বর্তমান পরিস্থিতি এখন এমনই যে রাজধানী ইম্ফল থেকে পাহাড়ী কুকি অধ্যুষিত এলাকায় যেতে প্রশাসনের নয়, কুকি রক্ষীদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দিনের বেলা নারীরা সীমান্ত পাহারা দেয় এবং রাতে পুরুষরা। এমনকি দুই সম্প্রদায়ের গ্রামের মধ্যে পারস্পরিক আক্রমণও চলছে।

বিবিসির খবরে আরও বলা হয়, কয়েকদিন আগে পর্যন্ত, তাদের কাছে লাইসেন্সকৃত বন্দুকও ছিল, কিন্তু এখন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী চারদিকে ঘাঁটি তৈরি করেছে এবং তারা গ্রামবাসীদের অস্ত্র ব্যবহার না করার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছে। মণিপুর কংগ্রেস পার্টির কার্যনির্বাহী সভাপতি দেবব্রত সিং বিবিসিকে বলেন, এখানে কখনও ধর্মের নামে কোনো দাঙ্গা হয়নি। এই প্রথমবার সেটা দেখলাম আমরা। কোনও মহল থেকে বোধহয় এই সহিংসতাকে ধর্মীয় দাঙ্গার রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button