৫ শতাংশ ধনীর হাতে ৩০ শতাংশ আয়
দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আয় বাড়লেও এর সিংহভাগই যাচ্ছে ধনীদের হাতে। আয়ের ৩০ শতাংশ যাচ্ছে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের হাতে। আবার দারিদ্র্যসীমায় থাকায় একই পরিমাণ মানুষ আয় করছে আয়ের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে একটি অংশের কাছে আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে, দেখা দিয়েছে আয়বৈষম্য। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এ এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা ৭০-৮০-এর দশকে দারিদ্র্য বৃদ্ধি নিয়ে যে উদ্বেগে ছিলাম। এখন এসব উদ্বেগ অন্যদিকে গেছে। এর মধ্যে দেশে আয়বৈষম্য বেড়েছে। এটি উদ্বেগের বিষয়। এর কারণ হতে পারে দেশে সঠিকভাবে কর্মসংস্থান করতে না পারা।’
দেশে একেকটি পরিবারের আকার গড়ে ৪ দশমিক ২৬। এর মধ্যে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ সদস্য আয় করেন। একটি পরিবারের গড় আয় ৩২ হাজার ৪২২ টাকা, একজন মানুষের গড় আয় ৭ হাজার ৬১৪ টাকা। পরিবারের মধ্যে যারা আয় করেন, তাদের গড় আয় ২৫ হাজার ৭০৭ টাকা।
২০১৬ সালে দেশের আয়ের ৩৮ শতাংশই ছিল শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের হাতে, যারা দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনী হিসেবে পরিচিত। এবার তা আরও বেড়ে হয়েছে ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশে। এই শ্রেণির মধ্যে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় এখন দেশের আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।
এতে দেখা যায়, শীর্ষ ধনীদের পরের গ্রুপের হাতে রয়েছে ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ আয়। তাদের চেয়ে একটু কম ধনী গ্রুপের হাতে আয় রয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তার পরের গ্রুপের হাতে রয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ আয়।
খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্যে দেখা যায়, দেশের আয়বৈষম্য বেড়ে দশমিক ৪৯৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। গিনি সূচক দশমিক ৫ শতাংশ হলে তাকে চরম আয়বৈষম্য হিসেবে ধরা হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ চরম আয়বৈষম্যের কাছাকাছি রয়েছে। তবে শহর এলাকায় চরম আয়বৈষম্য রয়েছে।
সাধারণত গিনি (কেউ কেউ জিনি বলেন) সহগ দিয়ে একটি দেশে আয়বৈষম্য কেমন, তা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। এটি বৈষম্য মাপার একটি পদ্ধতি। ১৯১২ সালে ইতালির সংখ্যাতত্ত্ববিদ কোরাদো গিনি বা জিনি এর উদ্ভাবক। সবার আয় সমান হলে গিনি সূচক হবে শূন্য। এর অর্থ হলো চরম সাম্য অবস্থা বিরাজ করছে। আর সব আয় একজনের হাতে গেলে সূচকটি হবে ১। এটি আবার চরম অসাম্য অবস্থা। এই দুই সীমার মধ্যে সূচক যত বাড়ে, অসাম্য তত বেশি। বাংলাদেশে এই বৈষম্য দিন দিন বেড়েছে।
বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির গিনি সহগ সূচক দশমিক ৬৫। আর সবচেয়ে কম বৈষম্যের দেশগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে আছে সুইডেন, ডেনমার্কসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। এসব দেশে গিনি সহগ সূচক ৩০-এর আশপাশে। এ ছাড়া ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর গিনি সূচক দশমিক ৪০ থেকে ৪৫-এর মধ্যে আছে।
গতকাল বুধবার এই জরিপের তথ্যপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ড. জিল্লুর রহমান বলেন, হয়তো ধনী যেভাবে বেড়েছে সেভাবে কর্মসংস্থান বাড়েনি। দেশে বৈষম্য বৃদ্ধির খবর উদ্বেগের। এলাকাভিত্তিক বৈষম্য তুলে আনা উচিত। তা ছাড়া সামাজিক এসব নির্দেশককে এসডিজি প্রাসঙ্গিক করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে দারিদ্র্য কমেছে এটি ঠিক। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা দারিদ্র্য কত সেসব তথ্য জরিপে আসা উচিত। এ সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে কভিডের পর তারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকলেও তাদের হিসেবে আনতে হবে।
তিনি বলেন, তথ্য দিয়ে যেসব গল্প হবে সেসব গল্প এসব তথ্যে উঠে এসেছে কি না, তা চিন্তা করতে হবে। ঢাকা বিভাগে দারিদ্র্য বেড়ে গেছে। এটা কেন বাড়ল? এখানে তো অর্থনৈতিক কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি। অথচ খুলনায় জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি। সেখানে দরিদ্রতা কম।
তার মতে, একটি পরিবারের বার্ষিক আয়ের বিপরীতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খুবই কম।
বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো খানার আয় ও ব্যয় জরিপ করা হয়। ওই জরিপের ফল অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ ওই সময় দেশের আয়ের ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ আয় করত। পরের ১৫ বছরে পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরের চতুর্থ খানার আয় ও ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের আয় কিছুটা বেড়ে হয়েছে আয়ের ৩১ শতাংশ, আর ২০১০ সাল পর্যন্ত তা আরও বেড়ে হয় প্রায় ৩৬ শতাংশ।
এরপর থেকে দেশের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির আয়ের অংশীদারত্ব দ্রুত বেড়েছে। যেমন ২০১৬ সালে দেশের আয়ের ৩৮ শতাংশই ছিল শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর হাতে। এবার তা আরও বেড়ে হয়েছে ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় এখন দেশের আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ।
স্বাধীনতার পর দেশে কয়েক গুণ বেশি আয়বৈষম্য বেড়েছে। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল মাত্র দশমিক ৩৬। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ৩৭। এর মানে হলো, ওই সময় দেশে দারিদ্র্য বেশি থাকলে আয়বৈষম্য ছিল তুলনামূলকভাবে সহনীয়। গত দেড় যুগে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০১০ সালে গিনি সহগ সূচক ছিল দশমিক ৪৫৮। ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ৪৮৩। সর্বশেষ ২০২২ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯। দশমিক ৫০০ পয়েন্ট পেরোলেই একটি দেশকে উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ এখন উচ্চ বৈষম্যের দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।