Bangladesh

৬৩ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারাক্রান্ত ঢাকা

রাজধানী ঢাকার আয়তন মাত্র এক হাজার ৪৬৩ বর্গকিলোমিটার। ছোট্ট আয়তনের এই শহরে ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি আটটি এবং বেসরকারি ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, রাজধানীতে অবস্থিত শতাধিক সরকারি-বেসরকারি কলেজেও যত্রতত্র অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে।

অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরো একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানীতে অনেক বেশি স্কুল-কলেজ চোখে পড়ে। এখন এর সঙ্গে আরেকটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে, সেটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। মূল সড়কের একটি মোড় ঘুরলেই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চোখে পড়বে। রাজধানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও ক্রমশ উচ্চশিক্ষার মান কমছে। ফলে দেশে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭০।

এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৫টি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, এই দেড় দশকে মোট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮৭টি। এর মধ্যে ২৬টি পাবলিক ও ৬১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

জানা যায়, রাজধানীর বড় সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে তাদের অধিভুক্তি বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এসব কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য আরেকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে এর মধ্যে আবার সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় চান। ফলে শিগগিরই রাজধানীতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আরো বাড়ছে। 

সূত্র জানায়, ঢাকায় ৫৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এর মধ্যে মানসম্পন্ন রয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১৫টি। বাকিগুলো মানহীন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারেও জায়গা করে নিতে পারছেন না। এর পরও প্রায় প্রতিবছরই রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ইউজিসিতে এখনো শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আবেদন জমা রয়েছে। আবার নতুন নতুন আবেদনও জমা পড়ছে। ফলে রাজধানীতে নতুন আরো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চলে তাহলে অসুবিধা নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি মান বজায় রেখে না চলে তাহলে আমরা তদারকি করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ 

বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণবিষয়ক টাস্কফোর্স গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। প্রতিবেদনের শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশে একীভূতকরণের মাধ্যমে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমানোর কথা বলা হয়েছে। সীমিত শিক্ষা বাজেটের সঠিক ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো অবস্থান নিশ্চিতে এ কৌশল নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা।

টাস্কফোর্সের সুপরিশের উদ্ধৃতি দিয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি একনেক সভা শেষে শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সেখানে সরকারি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এটা সত্য। সরকারি খাতে দেশে ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে গত সাত বছরে অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এত দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির রেকর্ড বাংলাদেশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে সাত-আট বছরে পরিকল্পনা এবং কয়েকটি কমিশন করা হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের অনুমোদন হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ২০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ভাড়া বাড়িতে চলছে। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও খুব কম। এসবের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০০ থেকে এক হাজার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। আর দেশের অর্ধেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাই ভয়াবহ। তাদের শিক্ষার্থী নেই, ক্লাসরুম নেই, গবেষণাগার নেই, শিক্ষক নেই। একটি স্কুলে যে সুবিধা আছে সেটাও তাদের নেই। ফলে সহজেই কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। তবে এ জন্য প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ন্যূনতম মানদণ্ড নির্ধারণ করা যেতে পারে। যারা তা পূরণ করতে পারবে না, তাদের ব্যাপারে একীভূতকরণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

জানা যায়, গত ১৫ বছরে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়েছে। এর সঙ্গে বেড়েছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছয় বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩-এ উঠে আসা এ তথ্য অনুযায়ী, দেশে উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা ৯ লাখ ছয় হাজার। এর আগে ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে চার লাখ পাঁচ হাজার জন উচ্চশিক্ষিত বেকারের তথ্য উঠে এসেছিল। সে হিসাবে ছয় বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ লাখ চার হাজার।

শিক্ষা কার্যক্রম শুরু না হওয়া আট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও ভিসি নিয়োগের বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখতে চিঠি দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। গত ১২ ডিসেম্বর ইউজিসি চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কম, সেখানে আপাতত নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

চিঠিতে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় (সাধারণ ও বিশেষায়িত) স্থাপন করা হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভবিষ্যতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড়াতে পারবে কি না তা পরিষ্কার নয়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি, সেগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে যেকোনো পদক্ষেপ স্থগিত রাখাই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। এ ছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন, সেগুলোতেও নতুন শিক্ষক বা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি জরুরি প্রয়োজন না হলে এখন স্থগিত রাখাই ভালো। এসব বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগতভাবে পরবর্তী সরকারের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার রেখে যাওয়া সমীচীন মনে করে।’

তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয় উদ্যোক্তা বা ট্রাস্টিদের অর্থে। ফলে সেখানে যেহেতু সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ নেই, তাই নতুন অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে এখনো কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় মানহীন ও নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে পারছে না, তাদের ব্যাপারে সরকার কঠোর হবে বলে ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা থাকতে হয়। কিন্তু নতুন যেসব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা তা দেখিনি। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় উদ্দেশ্যহীনভাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের মতো দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন মানসম্পন্ন কারিগরি ও ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠান। যাতে জনসংখ্যাকে জনশক্তিকে রূপান্তর করা যায়।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d