Hot

৬ পণ্যের একটিরও সরকারি দর কেউ মানছে না, দাম নির্ধারণের চার দিনেও বাস্তবায়ন করা যায়নি

এসব অভিযানে বিক্রেতাদের সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করা হচ্ছে। গত শনিবার ও গতকাল রবিবার দুই দিনে অভিযান চালিয়ে ৩১৬ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে সংস্থাটি।

রাজধানীসহ সারা দেশে সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি কার্যকর করতে গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮২টি প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস গতকাল রাতে বলেন, রবিবার সারা দেশে ভোক্তা অধিদপ্তরের ৩৭টি টিম ৫২টি বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছে।

সরকার খুচরা বাজারে ছয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। যদিও নির্ধারিত দর কেউ মানছে না। বাজারে অভিযান চলছে। কিন্তু তাতেও নতুন দর কার্যকর করানো যাচ্ছে না।

যেমন নির্ধারিত দর অনুযায়ী প্রতি কেজি আলু খুচরা বাজারে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার আলু, ডিম ও দেশি পেঁয়াজের দাম ঠিক করে দেয়। এর কোনোটিই বাজারে কার্যকর হয়নি। প্রায় প্রতি মাসেই বেঁধে দেওয়া হয় ভোজ্যতেল ও চিনির দাম। যদিও বাজারে দাম থাকে বেশি।

অভিযানকালে পণ্যের দাম কম নিলেও, পরে জরিমানার টাকাসহ বিক্রেতারা উশুল করে নেন। তখন দেখার কেউ থাকে না।

গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি মাসে রান্নার জ্বালানি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ঠিক করে দেয়। সেটাও ক্রেতারা নির্ধারিত দামে কিনতে পারেন না।

লাগামহীন এই পরিস্থিতির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সরকার তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম গতকাল ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক কর্মশালায় বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এটা সরকারকে ভাবাচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন ফসল উঠলে এবং সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

নির্ধারিত দর বনাম বাজারদর

দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে ২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে। তখন আতঙ্কের কেনাকাটা বাজারে সরবরাহ–সংকট তৈরি করেছিল। এরপর সরবরাহ–সংকট, দেশীয় পরিস্থিতিসহ নানা কারণে দর বাড়তিই ছিল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সরবরাহ–সংকট, মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, দেশে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। এতে লাফিয়ে লাফিয়ে পণ্যের দাম বেড়েছে।

দাম ঠিক করে দেওয়া পণ্যের একটি আলু। বিগত কয়েক বছর আলু নিয়ে এমন পরিস্থিতি হয়নি। সাধারণত মৌসুমের শুরুতে আলু প্রতি কেজি ১৫ টাকা এবং শেষ দিকে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এবার সেপ্টেম্বরেই আলুর কেজি ৫৫ টাকায় উঠে যায়। এমন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি আলুর দাম ঠিক করে দেওয়া হয় ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা।

এসব কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি উঠে গেছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১০ সেপ্টেম্বর জানায়, গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিবিএস উদ্বেগজনক মূল্যস্ফীতির হার প্রকাশের চার দিন পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বৈঠক করে তিন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গত শনিবার মুন্সিগঞ্জে হিমাগার পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, হিমাগার থেকে রসিদের মাধ্যমে ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে হবে। গতকাল সকালে দুটি হিমাগারে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত দরে আলু বিক্রি হচ্ছে না। রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজ নামের একটি হিমাগার থেকে মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই আলু চট্টগ্রামের আড়তে পাঠানোর কাজ চলছিল।

ঢাকার কারওয়ান বাজার, নতুন বাজার ও গুদারাঘাট বাজার ঘুরে দেখা যায়, আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। এ দর তিন দিন আগের তুলনায় কেজিতে প্রায় ৫ টাকা কম। তবে নির্ধারিত দরের চেয়ে ১০ থেকে ১৪ টাকা বেশি।

দেশি পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা। বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজ ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা নির্ধারিত দরের চেয়ে ২১ থেকে ২৫ টাকা বেশি।

প্রতি হালি ডিমের দর নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৮ টাকা, যা বাজারদরের চেয়ে সামান্য কম। সেই দরও কার্যকর হয়নি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তালিকা বলছে, প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা দরে।

সরকার যদি তেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের নির্ধারিত দর কার্যকর করতে পারে, তাহলে একটি পরিবারে মোটামুটি ২৫০ টাকা সাশ্রয় হবে এক মাসে। কিন্তু এই টাকার প্রায় দ্বিগুণ চলে যাবে রান্নার গ্যাসের বাড়তি দামের পেছনে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমিয়ে ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়, যা কার্যকর হওয়ার কথা গতকাল থেকে। তবে এখনো নতুন দামের তেল বাজারে আসেনি। অবশ্য ভোজ্যতেল বেশির ভাগ সময় নির্ধারিত দরে বিক্রি হয়। কিন্তু চিনিতে দর মানা হয় না। এখন প্রতি কেজি খোলা চিনির নির্ধারিত দর ১৩০ টাকা। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজিতে।

বিইআরসি চলতি মাসের জন্য ১২ কেজির প্রতিটি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ঠিক করেছে ১ হাজার ২৮৪ টাকা, কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। পাঁচজনের একটি পরিবারে মাসে দুটি সিলিন্ডার লাগে। এতে বাড়তি দিতে হয় ১৩২ থেকে ৬৩২ টাকা। ঢাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাম নেওয়া হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। ফলে রাজধানীর পরিবারগুলোর বাড়তি ব্যয় হয় মাসে ৪৩২ টাকা।

প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে দাম নির্ধারণ করে লাভ কী? জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বাজারদর প্রত্যাশিত পর্যায়ে আনতে আমরা সারা দেশে অভিযান চালাচ্ছি। আমাদের যা যা করা দরকার, তা করব।’ ভোজ্যতেল ও চিনির দাম আগে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা কেন কার্যকর হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি এখন কথা বলতে চান না। নতুন পণ্যের ঘোষিত দর কার্যকর করতে চান।

দাম কেন কার্যকর হয় না

বড় কোম্পানি, বাজার বিশ্লেষক, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারিত দর কার্যকর না হওয়ার চারটি কারণ জানা যায়—১. বড় কোম্পানি, উৎপাদক অথবা আমদানি পর্যায়ে দর কার্যকর করতে না পারা। ২. পাইকারি বাজার ও খুচরা পর্যায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি না থাকা। দেখা গেছে, যতক্ষণ বাজারে অভিযান চলে, ততক্ষণ দাম কম থাকে। ৩. চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা। সরবরাহ–সংকট থাকলে কোনোভাবেই নির্ধারিত দর কার্যকর করা সম্ভব নয়। ৪. বেড়ে যাওয়ার পর দর নির্ধারণে লাভ হয় না।

মুন্সিগঞ্জের কদমরসুল হিমাগারের ব্যবস্থাপক প্রশান্ত কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর আলুর উৎপাদন ও সংগ্রহ কম হয়েছে। ফলে দাম কিছুটা বাড়তি থাকার কথা। দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

আলুর উদাহরণ এ ক্ষেত্রে সামনে এসেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি হিসাব যা-ই হোক, হিমাগারে আলু মজুত কম হয়েছে, সেটা ব্যবসায়ীরা জানতেন। এ কারণে হিমাগারে আলু মজুতের ‘কাগজ’ কেনাবেচা হয়েছে। যাঁরা বেশি দর দিয়ে আলু কিনেছেন, তাঁরা কোনোভাবেই এখন লোকসান দিতে চাইবেন না। প্রয়োজনে আরও পরে আলু বিক্রি করবেন। সরকারের উচিত ছিল মজুত পরিস্থিতি ও আশপাশের দেশের দাম বিবেচনা করে আগে থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া।

ডিম উৎপাদনকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের একটি ডায়মন্ড এগ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার আহমেদ বলেন, বন্ধ খামার চালুর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। দেশে উৎপাদন না থাকলে ধরপাকড় করে কাজ হবে না।

সরকারি পরিসংখ্যানে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন কম ও চাহিদা বেশি বলেই দাম বেড়েছে। ডিম আমদানিই কার্যকর বাজার কৌশল। দাম নির্ধারণ করে দিয়ে লাভ হবে না। ২০১২ সালের জুনে ডিমের হালি ৪০ টাকায় উঠেছিল। তখন সরকার কিছু ডিম আমদানি করে। তাতেই দাম কমে যায়।

পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, যখন আমদানির দরকার ছিল, তখন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমদানির অনুমতি দেওয়া বন্ধ রেখেছে। দাম অনেকটা বেড়ে যাওয়ার পর আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। তত দিনে আবার ভারতে দাম বেড়ে গেছে।

তিন দিনে ৩১৬ ব্যবসায়ীকে জরিমানা

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিগত তিন দিনে বাজারে অভিযান চালিয়ে ৩১৬টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। গতকাল ৮২টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

গোলাম রহমান আরও বলেন, উৎপাদনস্থলে গিয়ে খোঁজখবর না নিয়ে বাজার অভিযানের মতো পদক্ষেপে হয়তো খুব বেশি লাভ হবে না। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে যথেষ্ট জনবল আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ, অভিযানকালে পণ্যের দাম কম নিলেও, পরে জরিমানার টাকাসহ বিক্রেতারা উশুল করে নেন। তখন দেখার কেউ থাকে না।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সেটা করতে হলে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তার একটা হলো মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে যেসব উপায়-উপকরণ আছে, তার সঠিক ব্যবহার করা। সেই কাজটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য করা কঠিন। এটা হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button