Bangladesh

৬ মাসে খুন, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতনের শিকার ১৫০ জন সাংবাদিক

৬ মাসে খুন, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতনের শিকার ১৫০ জন সাংবাদিক। – ছবি : ফাইল

চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ১৫০ জন সাংবাদিক খুন, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন, হুমকিসহ নানাভাবে আক্রান্ত ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারি ও জুন দু’মাসে খুন হয়েছেন দুই সাংবাদিক। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে আরো তিনজনের। মার্চ মাসে সর্বাধিক সংখ্যক ৪০ জন সাংবাদিক নিপীড়নের মুখে পড়েন। অন্য পাঁচ মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে ১৮, ফেব্রুয়ারিতে ২৫, এপ্রিলে ২৪ এবং মে মাসে ১৪ জন এবং জুন মাসে ২৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকসহ ডিজিটাল আইনে হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছেন এদের অনেকে। গ্রেফতার হয়ে জেলও খাটতে হয়েছে সাতজনকে।

দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র ও শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টালে নজর রেখে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মনিটরিং কমিটি সাংবাদিক নিপীড়নের এ চিত্র পেয়েছে। বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকনের নেতৃত্বে এ মনিটরিং কমিটিতে কাজ করছেন সহ সভাপতি রাশিদুল ইসলাম, সহকারি মহাসচিব শহীদুল্লাহ মিয়াজী, প্রচার সম্পাদক মাহমুদ হাসান ও দফতর সম্পাদক তোফায়েল হোসেন। সংবাদমাধ্যমে খবরের মর্যাদা পায়নি এমন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকলে তা এ পরিসংখ্যানের বাইরে।
প্রাপ্ত তথ্য পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে সদ্য সমাপ্ত জুন একজন খুনসহ মোট ২৯ জন সাংবাদিক হত্যা, হামলা, মামলা, গ্রেফতারসহ নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এ মাসের ২২ তারিখে নৃশংসভাবে খুনের শিকার হয়েছেন জামালপুরের বকশীগঞ্জের সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম। আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে পিটিয়ে এবং ইট দিয়ে মাথা থেতলে হত্যা করা হয় দৈনিক মানবজমিন ও বাংলা নিউজের সাংবাদিক নাদিমকে। চলতি মাসে দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হয়েছেন আটজন সাংবাদিক। ডিজিটাল আইনে পাঁচজনসহ মামলায় আসামি হয়েছেন ১০ জন সংবাদকর্মী। হয়রানিমূলক মামলায় দুই সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে। প্রাণনাশের হুমকিসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন আরো ১১ জন সাংবাদিক।

জুনে হামলার শিকার সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকার নাহিদ সাব্বির, লক্ষীপুরের এমরান হোসেন সোহাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দোস্ত মোহাম্মদ, কুষ্টিয়ার রাজু আহমেদ, বগুড়ার জোসেফ হোসেন প্রতীক, সুনামগঞ্জের স্বপন জাহান ও ফেনীর কামরুল আরেফিন। এদের প্রায় সবাই সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত হন। চলতি মাসে খুলনার একটি পত্রিকা অফিসে সশস্ত্র হামলা হয়েছে। চট্টগ্রামে চারটি আইপিটিভি ও অনলাইন বন্ধ করে অফিস সিলগালা করা হয়েছে।

চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে নির্মমভাবে খুন হন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার সাংবাদিক আশিকুল ইসলাম আশিক। রহস্যজনক মৃত্যুর পর লাশ উদ্ধার হয় আরো এক সিনিয়র সাংবাদিকের। মোট ১৮ জন সাংবাদিক নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হন এ মাসে। এর মধ্যে সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়েছেন পাঁচজন। দুই সম্পাদকসহ নয় সাংবাদিক বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়েছেন। তাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন একজন। চলতি মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে দু’টি।

রাজধানীর পল্লবীর বাসা থেকে সিনিয়র সাংবাদিক বিপ্লব জামানের অর্গগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার করুন এই মৃত্যু এখনো রহস্যাবৃত। আলোচ্য মাসে সাংবাদিকদের ওপর হামলার একটি ঘটনা ঢাকায় এবং চারটি ঘটেছে ঢাকার বাইরে। ঢাকার নয়াপল্টনে মনির হোসেন শুভ, নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজারে শাহজাহান কবির, ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মাহমুদুর রহমান তুরান, দিনাজপুরের চিরির বন্দরে মানিক হোসনে এবং সাভারে আশরাফ সিজেল হামলায় আহত হয়েছেন।

ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা, নিপীড়ন ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১২ জন হামলায় আহত হয়েছেন। দু’জন গুরুতর ও রক্তাক্ত জখম হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।

মামলায় আহতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকায় বাংলা মেইলের খলিলুর রহমান, ধামরাইয়ে শামীম খান, বগুড়ায় জেএম রউফ ও জহুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী সাংবাদিক মারজান আক্তার, নোয়াখালী কোম্পানীগঞ্জের নূর উদ্দিন মুরাদ, রাজশাহী কলেজে নাজমুল সাকিব ও শরীফুল ইসলাম, গাজীপুরের শ্রীপুরে আরিফ এবং কক্সবাজারে শঙ্কর বড়ুয়া রুমি, মাইন উদ্দিন শাহেদ ও তৌফিকুল ইসলাম লিপু। এর মধ্যে ধামরাইয়ের শামীম খান ও শ্রীপুরের আরিফের অবস্থা ছিল গুরুতর।

মার্চ মাসে ৪০ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নিপীড়ন ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২১ জন সাংবাদিক হামলায় আহত হয়েছেন। এ মাসে আলোচিত সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে সাভারে। প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জমানকে রাত গভীরে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পরে ডিজিটাল আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানকেও সেই মামলায় আসামি করার ঘটনায় তোলপাড় হয়। শামসুজ্জমান পরে জামিনে মুক্তি পান। সম্পাদক মতিউর রহমানও উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। এ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সম্পাদকসহ ছয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সংবাদ প্রকাশের জেরে অন্য আইনে আরো তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

মার্চ মাসে হামলায় আহত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকার সুপ্রীম কোর্ট এলাকায় পুলিশের লাঠিচার্জে জাবেদ আখতার, এসএম নূর মোহাম্মদ, ফজলুল হক মেধা, আবদুল্লাহ আল ফারুক, হুমায়ুন কোভিদ, সোলায়মান স্বপন, মেহেদী হাসান মীম ও ইব্রাহীন, পুরান ঢাকায় মাহমুদ হোসে অপু, সাভারে হুমায়ুন কবীর ও নয়ন ইসলাম, রূপগঞ্জে শরীফ ভূইয়া, কেরানীগঞ্জে শামসুল ইসলাম সনেট, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন ও জোবায়ের আহমদ, কুমিল্লার বুড়িচংয়ে মাহফুজ বাবু এবং গাইবান্ধায় সোলায়মান আলী।

প্রথম আলোর শামসুজ্জমান ছাড়াও এ মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গ্রেফতার হন দৈনিক সংগ্রামের সিনিয়র ফটো সাংবাদিক আজিজ ফারুকী, হয়রানিমূলক মামলায় জেল খাটেন দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক কামরুল হাসান দর্পন। ডিজিটাল আইনে মামলা হয় যুগান্তরের মাহবুব আলম লাবলু, খুলনায় দেশটিভির মো: অসিমসহ তিনজনের বিরুদ্ধে।

এপ্রিল মাসে ২৪ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নিপীড়ন ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪ জন সাংবাদিক হামলায় আহত হয়েছেন। চারটি স্থানে মামলায় আসামি হয়েছেন আট সাংবাদিক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পুরনো মামলায় এক সাংবাদিককে জেলে পাঠায় ঠাকুরগাঁওয়ের আদালত। এপ্রিল মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সংবাদ প্রকাশের জেরে অন্য আইনে আরো তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এপ্রিল হামলায় আহতদের মধ্যে রয়েছেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় হান্নান খাদেম, রুবেল আহমেদ ও জালাল হোসেন, নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে সোহেল কিরন, চট্টগ্রামের দোহাজারিতে আইয়ুব মিয়াজী, রাজবাড়িতে মইনুল হক ও মোজাম্মেল হক লাল্টু, কুমিল্লার দেবিদ্বারে শাহীন আলম, পটুয়াখালীর গলাচিপায় মো: রাসেল হোসেন, রংপুরে জাহাঙ্গীর আলম বাদল, নারায়নগঞ্জে আবীর শিকদার ও মামুন, মাগুরায় রোস্তম মল্লিক এবং ভোলার চরফ্যাশনে আদিত্য জাহিদ। এর মধ্যে সোহেল কিরণ, আইয়ুব মিয়াজী ও আদিত্য জাহিদের অবস্থা ছিল গুরুতর।

মে মাসে ১৪ জন সাংবাদিক হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আটজন সাংবাদিক হামলায় আহত হয়েছেন। দুটি স্থানে মামলায় আসামি হয়েছেন দুই সাংবাদিক। চারজন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়া বরিশাল সিটি নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ সেরনিয়াবাতের সাথে সদর উপজেলা জনপ্রতিনিধিদের মতবিনিময় সভা চলাকালে ৩০জন সাংবাদিককে কিছু সময়ের জন্যে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এ মাসে দুই সাংবাদিকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ দাবি করছে তারা আত্মহত্যা করেছেন।

হামলার শিকার সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন সুনামগঞ্জের আমিনুল ইসলাম এবং রূপগঞ্জের জিএম শহীদ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আসামি হন বরগুনার আমতলীর সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button