Hot

৭৪৩৯৮ মামলার প্রতিটি ঋণই ১ লাখ টাকার নিচে: গরিব কৃষকের হাঁসফাঁস

বড় ঋণখেলাপি এবং পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ দরিদ্র কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে * রাঘববোয়াল ঋণখেলাপির কারণে সরকারি ব্যাংক প্রায় খাদের কিনারে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না

স্বল্প ঋণ নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন গরিব কৃষক। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত পরিশ্রম করে যারা ফসল উৎপাদন করেন, তাদের কাছ থেকে সামান্য কটি টাকার জন্য হচ্ছে একের পর এক মামলা। তারা কৃষিঋণ নিয়েছেন মাত্র ৫ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা। এমন অঙ্কের প্রতিটি ঋণ আদায়ে এখন পর্যন্ত সার্টিফিকেট মামলা হয়েছে ৭৪ হাজারের বেশি। অথচ শতকোটি, হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। উলটো দাপটের সঙ্গে তারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে-এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়মরক্ষার মামলা করে ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের রক্ষার্থে প্রায় সময় দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের বিশেষ সুবিধা। অন্যদিকে স্বল্প ঋণের ক্ষেত্রে টাকা বকেয়া পড়লেই মামলা হচ্ছে নির্ধারিত সময়েই। জেলেও যেতে হয়েছে অনেককে। রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা এসব গরিব কৃষকের। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৯৯ কোটি টাকা আদায়ে ১ লাখের বেশি মামলা হয়েছে কৃষকদের বিরুদ্ধে।

বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-সামান্য টাকার জন্য গরিব কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করা ঠিক হচ্ছে না। তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। তারা তো টাকা পরিশোধ করে। গরিব কৃষক কখনো ব্যাংকের টাকা মেরে খায় না। খুব বেশি বিপদে না পড়লে তারা ব্যাংকের টাকা ঘুরানোর কথা না। সরকার ও ব্যাংকগুলোর উচিত কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা করা থেকে সরে আসা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের জুলাইভিত্তিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বল্প ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করা কৃষকদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৯ হাজার ৩৫৭টি মামলা (সার্টিফিকেট মামলা) করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক। যার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর পাওনা ৩৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৪ হাজার ৩৯৮টি মামলা রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটির পাওনা ১ লাখ টাকার নিচে। বাকি মামলা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। প্রায় ৫৭ হাজার মামলা করেছে ব্যাংকটি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ২ লাখ কোটি টাকা আদায়ে মামলা করা হয় মাত্র ২ লাখ ১৪ হাজার। অথচ কৃষকের মাত্র ৩৯৯ কোটি টাকা আদায়ে মামলা করা হয় এক লাখের বেশি। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দরিদ্র কৃষকদের এসব টাকা আদায় করতে যতটা তৎপর ব্যাংকগুলো, ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয় বড় বড় জালিয়াতচক্র থেকে টাকা আদায়ে। কারণ, লুটেরাদের থেকে ঋণ আদায়ের উদাহরণ খুবই নগণ্য।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশে একটা মহালুটপাটের অর্থনীতি চলমান রয়েছে। বড় ঋণখেলাপি এবং পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা এতটাই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী যে তাদের কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যায় তারা সরকারেরই অংশ। অথচ ছোট ছোট দরিদ্র কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এ দৃশ্য দেখে মোটেও অবাক হচ্ছি না। কারণ, যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এর থেকে ভালো কিছু আশা করার সুযোগ নেই।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। কৃষকদের বিরুদ্ধে করা ব্যাংকটির মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৮০০টি। টাকার অঙ্ক ২১৯ কোটি। একই সময়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মামলার সংখ্যা ১৭ হাজার ৫৯৮টি। টাকার অঙ্ক প্রায় ১০৩ কোটি। সোনালী ব্যাংক মামলা করেছে ১০ হাজার ২৮৪টি। টাকার অঙ্ক ৩৯ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকের মামলা ২ হাজার ৫৫০টি। টাকার অঙ্ক ৫ কোটি টাকা। এছাড়া বাকি মামলা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত আরও দুই ব্যাংক। জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বড় বড় রাঘববোয়াল ঋণখেলাপির কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রায় খাদের কিনারে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। অথচ গরিব কৃষককে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। তাদের ঋণ তো ‘গভীর সমুদ্রে এক ফোঁটা পানির মতো’। অর্থাৎ এতই সামান্য, যা বড়দের তুলনায় শতাংশেও আসবে না। এটা অগ্রহণযোগ্য, অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক।

জানা যায়, যেসব কৃষক ৫ হাজার টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে নানা কারণে তা ফেরত দিতে পারেননি, যা পাঁচ বছর হয়ে গেছে; সেই টাকা আদায়ে ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা করে, সেটাকে সার্টিফিকেট মামলা বলে।

১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে বলেন, ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক ২০২২ সালে ৪ হাজার ৬২১ জন ঋণগ্রহীতার ৮ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কৃষি ঋণ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু জুলাই মাসেই ৯ হাজার ৩৩৮ জন কৃষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাদের কাছে পাওনা টাকার অঙ্ক ৩৮ কোটি ৩৮ লাখ। কিন্তু সেই মাসে কৃষকের কোনো ঋণ পুনঃতফশিল হয়নি।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো সর্বশেষ ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিল করেছে। ফলে এসব ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এরপরও গত বছরের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। পুনঃতফশিল করা ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ২০ শতাংশের কাছাকাছি হতো। এদিকে গত বছরের শেষে পুনঃতফশিল করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ফলে খেলাপি ঋণের চেয়ে পুনঃতফশিল করা ঋণ এখন বেশি। এছাড়া ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করে আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।

এদিকে গত অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে পুরো ব্যাংক খাত। এ সময় শুধু ঋণ বিতরণ নয়, আদায়ও বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকার ঋণ শোধ করেছেন কৃষক, যা আগের অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ২৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত অর্থবছরে কৃষি ঋণ আদায় বেড়েছে ৫ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংক খাতে কৃষি ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ ৫২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor