৯ শতাংশের সুদ এখন ১৫-১৬ শতাংশ উচ্চ সুদে বিপাকে উদ্যোক্তারা
এলসি খোলার হার কমেছে ৭ শতাংশ আর উৎপাদন কমেছে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ * ক্রেডিট কার্ডের সুদ হবে ২৫ শতাংশ
বারবার ব্যাংক ঋণে সুদহার বৃদ্ধিতে চরম সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। ফলে ব্যবসা প্রসারসহ থমকে রয়েছে বিনিয়োগ। ব্যবসা ও বিনিয়োগে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বেশির ভাগ উদ্যোক্তা। তারা বলছেন, দেশে এখন বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। বরং ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার লড়াই করছেন। তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করায় ব্যাংক ঋণের সুদ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এলসি খোলার হার কমেছে ৭ শতাংশ আর উৎপাদন কমেছে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। এতে ঋণখেলাপি আরও বেড়ে যাবে।
জানতে চাইলে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। খরচ বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণে সুদের হার বারবার বাড়ছে। উচ্চ সুদ বহন করার মতো অবস্থা কারও নেই। তিনি বলেন, এতে কিস্তি পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। ফলে বাড়বে খেলাপি। তার মতে, ২০২৫ সালের মার্চ ও জুন প্রান্তিকে উচ্চ সুদের নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে। তখন ঋণখেলাপি অনেক বেড়ে যেতে পারে। শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। এর সঙ্গে আরও অনেক সূচক জড়িত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চলমান অস্থিরতায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য নয়-এমন পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতে ধস নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সুদহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা আপাতত তুলে রাখছেন অনেক উদ্যোক্তা। শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশলের যৌক্তিকতা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। বিনিয়োগ কমে যাওয়া, আমদানি-রপ্তানিতে নিম্নগতি ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে মারাত্মকভাবে। ফলে টান পড়েছে শিল্পোদ্যোক্তাদের আয়ের খাতে। এদিকে কাঙ্ক্ষিত উপার্জন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো ব্যাংক ঋণের কিস্তি দেওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, ৮-৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়েছি। বারবার বেড়ে সে হার এখন ১৫-১৬ শতাংশে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত এ হার কোথায় গিয়ে ঠেকে তা কেউ জানে না। এখন নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, টিকে থাকাই কঠিন। কোথায় কত টাকা খরচ হবে এবং কতটা মুনাফা হতে পারে, সেটা হিসাব করে বিনিয়োগ করে উদ্যোক্তারা। কিন্তু মাঝপথে যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে। এতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এলসি বা ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কমেছে (জুলাই-সেপ্টেম্বর)। এ সময়ে আমদানি করা হয়েছে শুধু শিল্পের কাঁচামাল। ফলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মোট আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। একইভাবে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে ২.৫০ শতাংশের মতো।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১০.৮৭ শতাংশ হয়েছে। গত তিন মাসে অর্থাৎ নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৬৬ শতাংশে। কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২০২২ সালের মে মাস থেকে বেশ কয়েকবার সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পলিসি রেট বাড়াচ্ছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়েছে এবং ঋণ নেওয়া আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। ২০২২ সালের মে মাসের পর থেকে এই নিয়ে ১১ বারের মতো নীতি সুদহার বাড়ানো হলো। আর নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মোট তিনবার বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নীতি সুদহার বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির যে চাপ ছিল সেটা কমে এসেছে। এটা সম্ভব হয়েছে নীতি সুদহারের মাধ্যমে। কিন্তু এতদিন আমাদের দেশে এটাকে বাড়ানো হয়নি। আমরাও মূল্যস্ফীতি কমাতে পারব বলে আশাবাদী। আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে।’
গভর্নর আরও বলেন, ‘যখন ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ ছিল তখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় বিনিয়োগ বাড়েনি। আবার তারও আগে যখন সুদের হার ১৫ শতাংশ ছিল তখন কি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল না? ছিল। সুতরাং শুধু সুদহার বাড়ালেই যে মূল্যস্ফীতি কমবে, বিষয়টি এমন নয়। যখন সুদহার ১৫ শতাংশ ছিল তখন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও ছিল। সেখানেই যেতে চাই। এর জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এখন চাইলেও কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি হবে না।’
এদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে মাসিক খরচ সামলাতে যারা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ নিচ্ছেন, তাদের জন্য দুঃসংবাদ দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেডিট কার্ডের সুদহারও বাড়ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এ সংক্রান্ত অনুরোধে সাড়া দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদহার বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ শতাংশ, যা এখন ২০ শতাংশ।