ইরান ও পাকিস্তানের হামলা-পাল্টা হামলা : কার লাভ, কার ক্ষতি?
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে চলতি সপ্তাহে পাল্টা-পালটি বিমান হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত হবার ঘটনা প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে শীতল সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটিয়েছে।
পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তের উভয় পাশে দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন পর্যায়ের বিদ্রোহ চলার ফলে উভয় দেশই হতাশ। আপাতদৃষ্টিতে উভয় দেশের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল বেলুচ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো, যাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইরান, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের জাতিগত বেলুচ অঞ্চলগুলোর জন্য একটি স্বাধীন বেলুচিস্তান গঠন করা।
মঙ্গলবার ইরান পাকিস্তানে হামলা চালায় এবং বৃহস্পতিবার পাকিস্তান ওই হামলার পাল্টা জবাব দেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, সংঘাত সম্প্রসারণ হবার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, ইরান ও পাকিস্তান কেন নিজেদের ভূখণ্ডের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর উপর হামলা না করে, একে অপরের ভূখণ্ডে বিদ্রোহীদের হামলা করার পথ বেছে নিলো।
পটভূমি
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ ৯ শ’ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এখানে আইনের শাসন না থাকায় চোরাচালনকারী ও উগ্রবাদীরা অবাধে চলাফেরা করে। উভয় দেশই একে অপরকে সন্দেহ করে আসছে যে সীমান্তের ওপারে তৎপর কিছু গোষ্ঠীকে তারা সমর্থন করছে অথবা নিদেন পক্ষে নমনীয় আচরণ করছে।
ধারনা করা হয়, সুন্নি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী জইশ আল-আদল, যাদেরকে লক্ষ্য করে ইরান মঙ্গলবার আক্রমণ চালায়, পাকিস্তান থেকে তৎপরতা চালাচ্ছে। ওই গোষ্ঠীটি ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে বলে ধারনা করা হয়।
বেলুচ লিবারেশন আর্মি গঠিত হয় ২০০০ সালে এবং এরা পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী ও চীনা অবকাঠামো প্রকল্পে হামলা চালিয়েছে। তারা ইরানে লুকিয়ে আছে বলে সন্দেহ করা হয় ।
কেন পাল্টা জবাব দিলো পাকিস্তান?
পাকিস্তান বলেছে, বৃহস্পতিবার ইরানে যে হামলা চালানো হয়েছে, তা বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি ও বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের গোপন আস্তানা লক্ষ্য করে করা হয়। পাকিস্তান ইরান ও তার অন্যান্য প্রতিবেশীর এই বার্তাও দিতে চেয়েছিল যে উস্কানি দিলে তারা তার পাল্টা জবাব দিতে পারে।
পাকিস্তান শেষবারের মতো ২০১৯ সালে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ করেছিল। পাকিস্তান বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে দুটিভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল এবং তাদের একজন পাইলট আটক করেছিল। এই ঘটনা ঘটে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে, নয়াদিল্লির ভাষায়, সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবিরে ভারতীয় হামলার পর।
কেন এখন?
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল সম্পর্ক রয়েছে, তবে এই হামলাগুলো সম্ভবত অভ্যন্তরীণ সূক্ষ্ম বিষয় দ্বারা প্ররোচিত।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ইরানে ইসলামিক স্টেট গ্রুপের প্রাণঘাতী হামলা, ইরানের মিত্র হামাসের বিরুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধ এবং তাদের ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক অস্থিরতার পর তেহরান ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে যেকোনো ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য।
বিশ্লেষকদের মতে, বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পেছনেও অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য কাজ করেছে।
ইসলামাবাদের পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের আবদুল্লাহ খান বলেন, ‘সরকার ও সেনাবাহিনী (মঙ্গলবার থেকে) প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে।’
তিনি বলেন, শক্তিশালী সেনাবাহিনী সম্পর্কে জনসাধারণের আগে যে ধারণা ছিল, তা আর নেই, সেকারণে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়েছে।’
পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে?
ইরানের সামরিক বাহিনী বৃহস্পতিবার থেকে পূর্ব-পরিকল্পিত বার্ষিক বিমান প্রতিরক্ষামহড়া শুরু করেছে। ওই মহড়া পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের কাছে চাবাহার বন্দর থেকে পশ্চিমে ইরাকের সীমান্ত পর্যন্ত চলছে। মহড়ায় বিমান, ড্রোন ওআকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থেকে তাজা গোলাবর্ষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে হামলা হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও এই সপ্তাহের হামলার প্রেক্ষাপটে তাদের নিজেদের সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে তাদের রাডার এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পরমাণু শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সাথে ক্রমাগত ও নিম্ন পর্যায়ের উত্তেজনা থাকার পরিপ্রেক্ষিতে, পাকিস্তানের জন্য এই ব্যবস্থাগুলো অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। ইরানের সাথে সীমান্তের পরিবর্তে, দীর্ঘদিন ধরেই ভারত সীমান্তে পাকিস্তান তাদের সরঞ্জামগুলো মোতায়েন রেখেছে।
অন্যদিকে, ইরান তার প্রধান শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সম্ভাব্য হামলা হতে পারে মনে করে তাদের রাডার এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করে।
বিমান হামলার তাৎপর্য কী?
এই হামলা শুরু করার ফলে তেহরান ইসরাইল বা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৃহত্তর সংঘাতের ঝুঁকি না নিয়ে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার দিকে ইঙ্গিত করতে পারে। বিশেষ করে যখন ইরানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনা রয়েছে।
পাকিস্তানের জন্য এই হামলা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপকে হালকা করতে পারে। তবে পরে হিতে বিপরীতও হতে পারে। কারণ, বেলুচ লিবারেশন আর্মি বলেছে যে তারা এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে।