রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কী আলোচনা করল ইইউ দল
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সফরকারী প্রতিনিধি দলের সাথে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন নিয়েই মূল আলোচনা হয়েছে। সেখানে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে থাকা মতবিরোধ আবারো বেরিয়ে এসেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময়ে বার্তা দিয়ে গেছেন, নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণকেই যেন সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
এই বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিদেশী কূটনীতিকদের তৎপরতা বেড়েছে। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে পরিস্থিতি বুঝতে বর্তমানে সফর করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রাক নির্বাচনী প্রতিনিধি দল।
সুশীল সমাজ, কূটনৈতিকদের সাথে বৈঠকের পর শনিবার প্রধান সাড়ির কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে বৈঠক করেছে এই দলটি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যে আলোচনা হলো
ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে প্রাক নির্বাচনী প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করছে, শনিবার তারা বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী।
শনিবার সকালে গুলশানে বিএনপির নেতাদের সাথে বৈঠক করে এই প্রতিনিধি দল।
বৈঠকের আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী পরবর্তীকালে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে যে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন আদৌ জনগণের ভোটের মাধ্যমে সম্ভব হবে কিনা।… আমাদের পক্ষ থেকে তাদের বলেছি, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, সম্ভব না। কারণ এদের অধীনে নির্বাচন হবে না।’
“আমরা বলেছি, তারা নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে জোর করে আবার ক্ষমতায় আসতে চায়। এই সরকারের অধীনে দেশের মানুষ তাদের ভোট প্রয়োগ করতে পারবে না। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে না‘’ – বলেন আমির খসরু।
নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষণ পাঠানো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা, জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘’তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। কথা হচ্ছে, নির্বাচন তো হতে হবে।”
“পর্যবেক্ষক আসার প্রশ্ন তখনই আসে, যখন একটি নির্বাচন হয়। এ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণ, গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিশ্বাস করে না, জনগণ বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোট দিয়ে সরকার গঠন করেছে। আগামীতেও বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। এই প্রেক্ষাপটে তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা তাদের ব্যাপার‘’ – বলেন তিনি।
বিএনপির সাথে বৈঠকের পর দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার একটি হোটেলে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
সেই বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তারা দেখতে চান, আমরাও বলেছি, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরও কমিটমেন্ট। বাংলাদেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব ও আইন ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তারা এখানে নির্বাচন দেখতে চায়। তারা নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে আশ্বস্ত হয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।
‘’নো সংলাপ এবং নো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পার্লামেন্টের বিলুপ্তি, সরকারের পদত্যাগ, এসব কোনো বিষয়েই আলোচনা হয়নি‘’- বলেন কাদের।
বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপ করার বিষয়ে যেসব পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, ‘’ক্ষমতাসীন দল হিসেবে সংলাপের বিষয়ে আওয়ামী লীগ কোনো উদ্যোগ নেবে কিনা, জানতে চাওয়া হলে দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমি একটা কথা পরিষ্কার বলতে চাই, নির্বাচন সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধান, এর বিধিবিধান- এর কোনো ব্যত্যয় আমরা মানি না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো নির্বাচনকালীন সরকার, যেভাবে থাকে, বাংলাদেশেও সেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। এখানে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত হওয়ার, সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নই ওঠে না।‘’
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান ওবায়দুল কাদের।
বিএনপি আর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকের মাঝে জাতীয় পার্টির সাথে আলোচনা করে এই দলটি।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গুলশানে সেই আলোচনা শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘’দেশের মানুষ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের প্রয়োজন আছে। সেজন্য সরকার ও ইসির ভূমিকা পালন প্রয়োজন।‘’
তবে ইইউ প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে তিনি জানান।
দুপুর আড়াইটায় জামায়াত নেতাদের সাথে বৈঠকে বসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল।
সেই বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’নির্বাচন কিভাবে স্বচ্ছ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা যায়, সেই ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, আমরা নির্বাচনে যেতে চাই, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে নির্বাচনে যাবো।‘’
‘’আগামী নির্বাচনে ডেলিগেটস পাঠানোর ব্যাপারে তারা আমাদের মতামত চেয়েছিল। আমরা বলেছি, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয় তাহলে স্বাগতম। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ডেলিগেটস আসা ঠিক হবে না। কারণ যদি একতরফা নির্বাচন হলে এখানে অবজার্ভ করার কিছু থাকবে না।‘’
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এসব আলোচনার বিষয়ে অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি।
‘বাংলাদেশের জনগণকে নেতা বেছে নেয়ার সুযোগ দিন’
যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া আড়াই দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে শুক্রবার ঢাকা ছেড়েছেন।
এর আগে তিনি বাংলাদেশের বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারটি নিজের ভেরিফায়েড টুইটারেও শেয়ার করেছেন।
সেখানে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা সহিংসতা পরিহার করে সত্যিকারের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের নেতা বেছে নেয়ার সুযোগ করে দেয়।
‘’সব দলের কাছে আমি অনুরোধ করছি যেন তারা সহিংসতা পরিহার করে এবং সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেন। বাংলাদেশের জনগণকেই তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দিন,’’ ইউএনবিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন।
উজরা জেয়া পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ‘’যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সহায়তা করা।‘’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচন বয়কট প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এটা বাংলাদেশের মানুষের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এবং এখানে যুক্তরাষ্ট্রের করণীয় কিছু আছে বলে তিনি মনে করেন না।
‘’আমি শুধু বলতে চাই, আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কোন দলের পক্ষ নেই না।‘’
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে ইউএনবির এক প্রশ্নের জবাবে উজরা জেয়া বলেছেন, সংশ্লিষ্ট তথ্যের ‘’সতর্ক পর্যালোচনা এবং বিবেচনার পরেই ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
‘’এখন দেখা যাচ্ছে, ওই নিষেধাজ্ঞা জারির পর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে,’’ তিনি বলেছেন।
কিন্তু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে তিনি বলেছেন, অতীত ও বর্তমানের সকল অভিযোগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রতিষ্ঠান হিসাবে র্যাবের অর্থবহ সংস্কার করতে হবে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনায় থাকবে বলে তিনি জানান।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে চায় বলে উজরা জেয়া জানিয়েছেন।