দুই দলই ইইউর সমর্থন চায়
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো যায় কি না, তা বুঝতে দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে ইইউ।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি
বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কোনো পর্যবেক্ষক আসেননি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ওই দুটি নির্বাচন নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তবে এবার জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার একধরনের চাপে পড়েছে। বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থা নিয়েও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে একধরনের চাপের মুখে সরকার এবার ইইউসহ বিদেশি পর্যবেক্ষক এনে নির্বাচন করতে চায়।
এটি সরকারের একটি কৌশল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। একইভাবে তাঁরা মনে করেন, বিএনপিও কৌশলের অংশ হিসেবে ইইউ প্রতিনিধিদের এই সফরকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ, নিজেদের দাবির প্রতি সমর্থন আদায়ে এটিকে একধরনের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছে দলটি। কার্যত দুই দলই নিজেদের অবস্থানের প্রতি ইইউর সমর্থন চায়।
সরকারের আমন্ত্রণে ইইউর প্রতিনিধিদল এখন ঢাকা সফর করছে। গতকাল শনিবার তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ পাঁচটি দলের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করেছে। আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো না পাঠানো প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পরিস্থিতি বোঝার জন্য এই সফর করছে ইইউ। আলোচনায় প্রতিনিধিদল মূলত নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে দলগুলোর অবস্থান ও বক্তব্য শুনছে। ইইউ প্রতিনিধিদের এই সফর ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক কতটা গুরুত্ব বহন করে, সেই প্রশ্নও আলোচনায় রয়েছে।
পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ইইউ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।
অধ্যাপক হারুন অর রশিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুবউল্লাহ মনে করেন, আগামী নির্বাচনে ইইউ কী ভূমিকা নেবে, সেটি তারা এখনো স্পষ্ট করছে না। তারা রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের বক্তব্য শুনছে। এর বাইরে ইইউ তাদের কোনো বক্তব্য পরিষ্কার করছে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও গতকাল জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও এবি পার্টির সঙ্গে ইইউ দল পৃথকভাবে বৈঠক করেছে। তারা আবারও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করতে পারে বলে জানা গেছে।
ইইউর সঙ্গে গতকালের বৈঠকের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ইইউর প্রতিনিধিদল অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চলমান পরিস্থিতিতে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না—এ প্রশ্ন ছিল ইইউ প্রতিনিধিদলের।
অন্য তিনটি দলের সঙ্গে বৈঠকেও তারা নির্বাচনের পরিবেশ নিয়েই জানতে চেয়েছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার ঢাকা সফরের সময়ও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে।
আগামী নির্বাচনে ইইউ কী ভূমিকা নেবে, সেটি তারা এখনো স্পষ্ট করছে না।
অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
গতকাল ইইউ প্রতিনিধিদল জামায়াতে ইসলামী ও এবি পার্টির সঙ্গে কেন বৈঠক করল—এই প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, জামায়াতের এখন নিবন্ধন না থাকলেও দেশের রাজনীতিতে দলটির একটা অবস্থান রয়েছে। এ ছাড়া ইসলামি দলগুলোর দিক থেকে প্রতিনিধি হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে তারা কথা বলে থাকতে পারে।
অন্যদিকে জামায়াতের একদল নেতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে এবি পার্টি গঠন করেছেন। দলটি নতুন হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাইরে তাঁরা একটা অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া ব্রিটেনে প্রবাসীদের মধ্যে তাঁদের প্রভাবশালী কিছু সমর্থক রয়েছেন—এসব কারণে এবি পার্টির সঙ্গে ইইউ বৈঠক করেছে বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন।
নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রশ্নে এবারই প্রথম ইইউর পক্ষ থেকে এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল এসেছে। সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে ইইউ থেকে বা বিদেশি কোনো পর্যবেক্ষক আসেননি। তখন আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করেছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনের সময় তাদের ভিসা দেওয়া হয়নি। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ব্যাপারে তখন সরকারের অনীহা ছিল। তবে কানাডার একটি পর্যবেক্ষক দল এসে ‘ভালো’ নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছিল। অবশ্য কানাডার দলটি ফেরত যাওয়ার পর তাদের সেই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
এখন আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর ব্যাপারে সরকারের আমন্ত্রণে ইইউ দল ১৬ দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে। ৯ জুলাই তারা ঢাকায় এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ইইউ প্রতিনিধিদের এই সফর এবং দলগুলোর সঙ্গে তাদের বৈঠকের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তারা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনকারী বিএনপি এখন সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার কথা বলছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ যারাই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে, তাদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। দলটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব সম্ভাবনা বা উপায়কেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও সরকার বলছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়। এ জন্য বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ব্যাপারে তারাও আগ্রহ দেখাচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু করার ব্যাপারে ইইউ দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছে, হয়তো কিছু পরামর্শও দিচ্ছে। তবে দলগুলো যদি তাদের গুরুত্ব না দেয়, তাহলে এসব বৈঠকের কোনো গুরুত্ব নেই। তিনি মনে করেন, ক্ষমতাসীন দল ইইউর সফরকে মুখে গুরুত্বপূর্ণ বললেও আসলে এটি তাদের কৌশলের অংশ। আর বিএনপি তাদের দাবির সমর্থনে সম্ভাব্য সব সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে তারা ইইউর সফরকে গুরুত্ব দিচ্ছে।