Bangladesh

নেতাকর্মীর কাঁধে মামলার বোঝা

এমনিতেই মামলা-মোকদ্দমায় নাকাল মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এর মধ্যে নির্বাচন ঘিরে চট্টগ্রামের প্রতিটি থানায় দলটির উল্লেখযোগ্য সব নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলাই নাশকতার। এসব মামলার বাদী পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর থেকে নির্বাচনের দিন ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭১ দিনে চট্টগ্রামে ৭৪টি মামলা হয়েছে।

আগে থেকেই বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মীর নামে শতাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় জড়িয়ে দলটির নেতাকর্মীর ত্রিশঙ্কু অবস্থা। নতুন করে গতি বাড়ায় মামলার বোঝা আরও বেড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন এসব নেতাকর্মী। অনেকের চাকরি গেছে, কারও কারও ব্যবসা-বাণিজ্যও যায় যায়।

নির্বাচন ঘিরে ৭৪ মামলা ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের পর নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ৭১ দিনে ৭৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার নেতাকর্মীকে। 

চট্টগ্রামে বিএনপির তিনটি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরে মামলা হয়েছে ৩০টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ৮০০ নেতাকর্মী। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি নগরীর চান্দগাঁওয়ের মৌলভী পুকুর এলাকায় নির্বাচন চলাকালে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গে বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয় তিনটি। এতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, নগর বিএনপি নেতা এরশাদ উল্লাহসহ ৪৫ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ ও ২০০ থেকে ৩০০ নেতাকর্মীকে অচেনা আসামি দেখিয়ে মামলা করা হয়। শুধু ওই মামলায় এরই মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এই থানা এলাকায় এখনও প্রায় প্রতিদিনই বিএনপি নেতাকর্মীর বাসায় অভিযান চালানো হচ্ছে। চলছে গ্রেপ্তার। নগরীর অন্য এলাকায় পুলিশ কিছুটা নমনীয় থাকলেও চান্দগাঁওয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার বিভিন্ন থানায় বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২১টি। এসব মামলায় প্রায় সাড়ে ৪০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলায় আসামি হিসেবে নাম রয়েছে জেলা বিএনপির প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম উত্তর জেলায় মামলা হয়েছে ২৪টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় অন্তত সাড়ে ৪০০ নেতাকর্মীকে। নির্বাচনের পর অবশ্য চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলায় নতুন করে আর কোনো মামলা হয়নি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে দলটির নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

মামলায় নাস্তানাবুদ নেতাকর্মীরা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে এখন ৯৩ মামলা। পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধা, ভাঙচুর, নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে রয়েছে ৬৪টি মামলা। নতুন করে তিনটি মামলায় নাম উঠেছে তাঁর। সব মিলিয়ে এখন তাঁর নামে ৬৭টি মামলা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা ছিল ৪৫টি। নির্বাচন ঘিরে নাশকতার আরও চারটি মামলা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এখন তাঁর মামলা সংখ্যা ৪৯টি। দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমদ খানের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে আটটি। সব মামলায় জামিনে রয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৩টি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য গাজী সিরাজ উল্লাহর বিরুদ্ধেই রয়েছে শতাধিক মামলা। নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক আলী মুর্তজা খানের বিরুদ্ধে রয়েছে ১১০টি। ৬৭টি মামলার আসামি নগরীর খুলশী থানা বিএনপির সভাপতি আবদুল হালিম। বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগও করেছেন তারা। এভাবে কমবেশি মামলা রয়েছে বিএনপি বেশির ভাগ নেতাকর্মীর নামে। বেশির ভাগ মামলায় জামিনে থাকলেও পুলিশের ধরপাকড় ঘরে থাকতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। 

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো গায়েবি মামলা। আবার মামলা থাকুক কিংবা না থাকুক, পুলিশ নেতাকর্মীর বাড়িতে হানা দিচ্ছে। কাউকে না পেলে পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে নিয়ে যাচ্ছে। মামলায় জড়িয়ে দিচ্ছে।’ 

বিএনপি নেতাকর্মীর মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী কামরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি জানিয়েছেন, বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যেসব মামলা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে এসব মামলা দেওয়া হচ্ছে। অনেক মামলা তদন্ত না করেই অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে।

ছেলেকে না পেলে ভাই-বাবাকে গ্রেপ্তার
পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীর বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তকে না পেলে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

বিএনপির দেওয়া তথ্যমতে, গত ২২ নভেম্বর বাঁশখালী ছাত্রদল নেতা মঈনুদ্দীন জায়েদকে না পেয়ে তাঁর বড় ভাই ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলামকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় আদালতে চালান দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। এর আগে গত ২০ নভেম্বর নগর ছাত্রদল নেতা রকি হোসেনের ছোট ভাই রিয়াজ হোসেন রাব্বিকে খুলশী থানা পুলিশ একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। পতেঙ্গা থানা পুলিশ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মিয়া ভোলার ছোট ভাই মো. শফিউল আলমকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পতেঙ্গা থানা যুবদল নেতা শাহিনকে না পেয়ে তাঁর ভাই আলী নুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সুমনকে না পেয়ে তাঁর বৃদ্ধ বাবা মো. কবিরকে বায়েজিদ বোস্তামির দোকান থেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারি চান্দগাঁও থানা পুলিশ মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি নওশাদ আল জাসেদুর রহমানের বড় দুই ভাই আবেদ মাহমুদ রহমান ও ব্যাংকার জাবেদুর রহমানকে থানায় নিয়ে যায়। পরে আবেদ মাহমুদ রহমানকে বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দপ্তরে দায়িত্বে থাকা মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে পুলিশ মারমুখী। নেতাকর্মীর বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হানা দিচ্ছে। ছেলেকে না পেলে বাবাকে, ভাইকে না পেলে আরেক ভাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।’ 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button