স্থবিরতার মুখে বরিশাল অঞ্চলের রেল যোগাযোগ প্রকল্প
বৃটিস যুগ থেকে দেশের পাঠ্যবইতে প্রশ্ন ছিল, ‘রেল লাইন নেই কোন জেলায়’ ? উত্তর- ‘বরিশাল জেলায়’ ! তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুঃসাহসিক প্রকল্প হিসেবে এককালের রেলপথহীন নদী-নালার বরিশাল অঞ্চলকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহন করলেও অজ্ঞাত কারণে তা ক্রমশ স্থবির হয়ে পড়ছে। এ লক্ষ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরে সম্ভাব্যতা সমিক্ষা, এলাইনমেন্ট নির্ধারন, বিস্তারিত নকশা প্রনয়ন ও দরপত্র দলিল ২০২১-এর জুলাইয়ে রেল বিভাগে জমা দেয়ার পরে এ মেগা প্রকল্পটি অনুমোদনের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। এমনকি ‘৪১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা ব্যায় সাপেক্ষ ২১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথ নির্মান প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম যত বিলম্বিত হবে, প্রকল্প ব্যায় ততই বাড়বে’ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল।
এ রেলপথ নির্র্মানে যে ৫ হাজার ৬৩৮ একর ভূমি অধিগ্রহন করতে হবে, সময় যত গড়াবে তার মূল্য বৃদ্ধির ফলেও প্রকল্পব্যায় বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এমনকি এ প্রকল্পটিও আগামী জাতীয় নির্বাচনে দক্ষিণাঞ্চলে সরকার দলীয় প্রার্থীদের নানা প্রশ্নের সম্মুখিন করতে পাড়ে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। তবে বরিশাল অঞ্চলে ক্ষমতাশীন দলের জাতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা প্রকল্পটি নিয়ে আশা ছাড়েন নি। তাদের মতে, ‘একমাত্র শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব এ মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন’। কিন্তু প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এগিয়ে নিতে তাদের তেমন কোন তৎপড়তা বা উদ্যোগও লক্ষণীয় নয়।
এমনকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিবেচনা মতে পিপিপি পদ্ধতিতে ডিপিএম-এ ১টি প্যকেজে বা ওটিএম পদ্ধতিতে ৪টি প্যাকেজে বাস্তবায়নযোগ্য এ ‘প্রকল্প-সারপত্র’ এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা কমিশনের উচ্চ পর্যায়ে বিবেচনার জন্যও উথ্বাপিত হয়নি।
ফলে কবে রেললাইন বিহীন দক্ষিণাঞ্চলে ট্রেনের হুইস্যাল শোনা যাবে তা বলতে পারছেন না রেলপথ মন্ত্রনালয় বা রেলপথ বিভাগের দায়িত্বশীল কেউ।
ইতোপূর্বে ২০২৩-এর জুলাই নাগদ ফরিদপুর-বরিশাল-পায়রা বন্দর-কুয়াকাটা রেললাইন প্রকল্পটির বাস্তব অবকাঠামো নির্মান কাজ শুরু করে ২০২৮-এর মধ্যে ট্রেন চালু করতে আশাবাদী ছিল রেলপথ বিভাগ। এমনকি প্রথম ৩ বছরের মধ্যে ভাংগা থেকে বরিশাল সেকশনের ৯৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মান সম্পন্ন করে ট্রেন চালুর সম্ভবনার কথাও বলেছিলেন একাধিক কারিগরি বিশেষজ্ঞ।
কিন্তু পুরো বিষয়টি এখন অন্ধকারে। একদিকে প্রকল্পটির জন্য দাতা বা বিনিয়োগকারীর অভাব, অন্যদিকে নানা অজ্ঞাত কারণে সরকারের ওপর মহলে আগের মত আগ্রহের ঘাটতি পুরো বিষয়টিকে স্থবির করে দিচ্ছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এমনকি এ রেলপথ নির্মানে ভ’মি অধিগ্রহনেও অন্তত ৩ বছর লেগে যেতে পাড়ে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টগন জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৮-এর অক্টোবরে ফরিদপুরের ভাংগা জংশন থেকে বরিশালÑপায়রাÑকুয়াকাটা রেলপথ নির্মানের সম্ভাব্যতা সমিক্ষা, বিস্তারিত নকশা প্রনয়ন ও টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরীর লক্ষে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী ২০২০-এর মার্চে প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাবিত এ রেলপথ, স্টেশন ও জংশন স্থাপনের সমিক্ষা সহ বিস্তারিত নকশা জমা দেয়ার কথা থাকলেও সে কাজটি সম্পন্ন হয়েছে পরের বছর জুলাই মাসে। করোনা সংকটের পাশাপাশি এলাইনমেন্ট পরিবর্তনের কারণেও বিলম্বের কথা জানিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সরকারের সিদ্ধান্তনুযায়ী প্রস্তাবিত রেলপথের কয়েকটি স্থানে পুনরায় জরিপ পরিচালনা করে নতুন এলাইনমেন্ট অনুযায়ী নকশা প্রনয়ন করা হয়।
২১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথ নির্মানের ফলে পায়রা বন্দর ছাড়াও পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা এবং বরিশাল বিভাগীয় সদর সহ দক্ষিণাঞ্চল রেলপথে ভাংগা জংশন হয়ে রাজধানী ঢাকা সহ উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি সারা দেশের সাথে যুক্ত হবার কথা।
পরমর্শক প্রতিষ্ঠান ভাংগা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত প্রস্তাবিত সিঙ্গেল লেন ব্রডগেজ এ রেলপথে ১১টি স্টেশনের প্রস্তাব করেছে। মূল জংশন থাকবে ফরিদপুরের ভাংগাতেই। সেখান থেকে একটি লাইন পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় এবং অপর একটি লাইন ভাটিয়াপাড়াÑকালনা-নড়াইল-যশোর ও খুলনা ছাড়াও বেনাপোল এবং অপর লাইনটি ফরিদপুরÑরাজবাড়ী-কুষ্টিয়া পাকশি সেতু হয়ে উত্তরবঙ্গের লাইনে যুক্ত হবে। প্রস্তাবিত বরিশাল-কুয়াকাটামুখি রেলপথে ভাংগা’র পরে টেকেরহাট, মাদারীপুর, গৌরনদী, বরিশাল বিমান বন্দর, বরিশাল মহানগর, বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, আমতলী,পয়রা বিমান বন্দর, পায়রা বন্দর হয়ে সর্বশেষ কুয়াকাটাতে স্টেশন নির্মানের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্টেশনগুলোর ভবন দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ইলিশ মাছের আদলে নির্মানের নকশা করা হয়েছে।
বৃটিস যুগেই ফরিদপুরÑবরিশাল রেল লাইন স্থাপনের লক্ষ্যে ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগে জরিপ কার্যক্রম শুরু করে প্রায় ৫০ বছর পরে প্রতিবেদন পেস করা হলেও নদীÑনালার দেশ বরিশালে রেল লাইনে বিপুল সংখ্যক সেতু ও কালভার্ট নির্মান করতে হবে বিধায় প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়। দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তান সরকার ফরিদপুরÑবরিশাল রেল যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে বৃটিস যুগের এলাইনমেন্ট অনুযায়ী ভ’মি অধিগ্রহন সম্পন্ন করলেও মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
তবে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী শহিদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম মঞ্জুর-এর উদ্যোগে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু করে ফরিদপুর প্রান্ত থেকে লাইন নির্মান কাজ শুরু হয়। প্রথমে ফরিদপুর থেকে তালমা পর্যন্ত লাইন নির্মান ও রেল যোগাযোগ শুরু হয়। ১৯৮২ সালে লাইন স্থাপন ও স্টেশন নির্মান সম্পন্ন করে পুকুরিয়া পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার রেল যোগাযোগ চালু এবং ভাংগা পর্যন্ত মাটির কাজ সম্পন্ন হয়। কিন্তু এরশাদ সরকার ক্ষমতা দখলের পরে ১৯৮৩ সালে ফরিদপুর-বরিশাল রেল প্রকল্পটি বাতিল করে অধিগ্রহনকৃত ভ’মি অবমূক্ত করার নির্দেশ দেন। ফলে বরিশাল সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল রেল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের বাইরে থাকার বিষয়টি স্থায়ী রূপ লাভ করে।
কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলে রেল যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ প্রদান করায় ফরিদপুর থেকে পুকুরিয়া হয়ে ভাংগা পর্যন্ত পুনরায় লাইন স্থাপন করে রেল যোগাযোগ চালু হয়েছে। পাশাপাশি বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর ও পর্যটন নগরী কুয়াকাটা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভ্যতা সমিক্ষা, এলাইনমেন্ট নির্ধারন, দরপত্র দলিল প্রস্তুত সহ ভ’মি অধিদগ্রহনের বিস্তারিত প্রতিবেদন গ্রহনের এক বছর পরেও তা আর পরিকল্পনা কমিশনের বিবেচনার জন্য উথ্বপিত হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, এসিয় উন্নয়ন ব্যাংক এক সময়ে ফরিদপুর-বরিশাল রেলপথ নির্মান নিয়ে আগ্রহ দেখালেও বিষয়টি নিয়ে সেখানে যোড়ালভাবে কোন প্রস্তাব উথ¥াপন করা হয়নি। এমনকি পরিকল্পনা কমিশনের বহিঃসম্পদ বিভাগ-ইআরডি থেকেও প্রকল্পটি নিয়ে দাতা বা বিনিয়োগকারী সন্ধানে এখন আর তেমন কোন উদ্যোগ নেই বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।