সবাই ‘ভিআইপি’ চোর!, চুরি করে ওরা গ্রামের বাড়ি যায় বিমানে!
ওরা জনা চল্লিশেক। সবাই ‘ভিআইপি’ চোর! রাজধানী ঢাকায় থাকেন ফ্ল্যাটে। ঘুরে ঘুরে চুরি করে বেড়ান। চোরাই পণ্য বেচে আয়-রোজগারও বেশ। গ্রামের বাড়ি যান উড়োজাহাজে চেপে। এই চোর চক্রের দলনেতা কক্সবাজারের চকরিয়ার মধ্যম কোনাখালীর নোমান। চোরাই মোবাইল ফোন বেচাকেনার জেরে এক কলেজছাত্র খুনের রহস্য ভেদ করতে গিয়ে পুলিশ খুঁজে পেয়েছে এই ‘ভিআইপি’ চোরের দলকে। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন দলের প্রধান নোমানসহ তিনজন। চক্রের অন্য সদস্যদের ধরতে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিরুনি অভিযান।
আসবাহুল ইসলাম জিহাদ ছিলেন কক্সবাজার সিটি কলেজের ছাত্র। একদিন মায়ের কাছে বায়না ধরেন দামি মোবাইল ফোনের। চকরিয়ার মধ্যম কোনাখালীর নোমানের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকায় ফোনসেটও কেনেন। তবে কয়েক দিন পরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফোন ট্র্যাক করে জিহাদকে জানায়, তাঁর শখের সেটটি চোরাই ফোন। এরপর তিনি ফোনটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেন। চোরাই ফোন কিনে ফেঁসে যাওয়ায় নোমানের কাছ থেকে টাকা ফেরত চান জিহাদ। ১০ হাজার টাকা ফেরতও দেন। তবে বাকি টাকা ফেরত দিতে শুরু করেন গড়িমসি।
গত ১ ডিসেম্বর কৌশলে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে জিহাদকে ডেকে নেন নোমান ও তাঁর সঙ্গীরা। এরপর ধারালো অস্ত্র, ছোরা ও লোহার রড দিয়ে তাঁকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন। বুকের বাঁ পাশে ছুরি দিয়ে জখম করা হয়। এরপর আশপাশের লোকজন জিহাদকে পেকুয়া হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। চোরাই মোবাইল ফোন কিনে নিরপরাধ কলেজছাত্রকে যেভাবে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছে, তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে।
চকরিয়ার কোনাখালীর বাসিন্দা নোমানের নেতৃত্বে একটি ‘ভিআইপি’ চোর চক্র সক্রিয়। এই গ্রুপের ৪০ সদস্যের ব্যাপারে তথ্য মেলে। ২০১৭ সাল থেকে এই গ্রুপ সক্রিয়। একসময় তাদের দলনেতা ছিলেন রিদওয়ান। একাধিক মামলায় কারাভোগের পর তিনি এই পথ ছাড়েন। এরপর দলনেতা হিসেবে রিদওয়ানের পদটি নেন নোমান।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, চকরিয়ায় কোনাখালীর নোমানের সঙ্গে আরও যারা চোর চক্রে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ছড়াপাড়ার মো. মোবারক, বখতিয়ার, বোরহান, আমজাদ, দানু, সাইফুল ইসলাম, সোহেল, রমিজ রানা, মুবিন, ফারুক ও সোহান। গাবতলী, উত্তরা ও সবুজবাগ এলাকায় তারা আলাদা বাসা নিয়ে চুরি করে আসছিলেন। চক্রের একটি গ্রুপ বছরজুড়ে ঘুরে ঘুরে ঢাকায় বাস করেন। আর মধ্যরাত থেকে টার্গেট করা বাড়িতে হানা দেন তারা। বিশেষ করে ভোরে যখন অনেকে নামাজ পড়তে ঘর থেকে বের হন, তখন তারা কৌশলে বাসায় ঢোকেন। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান। চুরির মিশন শেষে চোরাই মালপত্র কুরিয়ারে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেখানে তারা এসব বিক্রি করেন। কক্সবাজারের সালাউদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী নিয়মিত চোরাই পণ্য কেনাবেচা করে আসছেন। সালাউদ্দিনকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যম কোনাখালীর যে চোর সিন্ডিকেট ঢাকায় সক্রিয়, তাদের রয়েছে নিজস্ব কৌশল। দলে টানার পর নোমান প্রথমে সবাইকে প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা দিয়ে থাকেন। কীভাবে দ্রুত একটি ফোনসেট ‘রিসেট’ ও ‘আইএমইআই’ নম্বর বদল করতে হয়, সেটি শেখানো হয়। এমনকি শুরুতে চোর চক্রের মূল দলে রাখা হয় না। চকরিয়া থেকে আনার পর নোমান নতুন সদস্যদের উদ্দেশে বয়ান দেন। প্রথমে গাড়ির যাত্রীদের টার্গেট করে টানা পার্টির সদস্য হয়ে কাজ করতে হয়। সেখানে পারদর্শিতা দেখালে বাসাবাড়িতে চুরির কাজে নিযুক্ত করা হয়। কেউ ধরা পড়লে তাঁকে জামিনে ছাড়িয়ে আনার কাজও এই চক্রের সদস্যরা করেন।
২৯ আগস্ট মিরপুর থানা পুলিশের পক্ষ থেকে ফেসবুকে সিসি ক্যামেরার একটি ছবি পোস্ট করে তাদের পরিচয় জানাতে নাগরিকদের অনুরোধ করা হয়। তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছিল পুলিশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৭ আগস্ট মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের ‘চ’ ব্লকের ৫ নম্বর সড়কের ২৪১ নম্বর বাড়ি থেকে সাতটি ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল সেট ও ১৩ হাজার টাকা চুরির ঘটনা ঘটে। ওই বাসায় ফ্রি ল্যান্সার হিসেবে গ্রাফিক ডিজাইনের ব্যবসা করে আসছিলেন শাহরিয়ার হোসেন। এ ঘটনায় মিরপুর থানায় মামলা করা হয়। এরপর পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে চক্রের সদস্যদের পরিচয় নিশ্চিত হতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি পোস্ট দেয়। তদন্তে উঠে আসে, মিরপুরে চুরি ওই ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মধ্যম কোনাখালীর দাগি চোর নোমান। এ ছাড়া ঢাকায় আরও বেশ কয়েকটি চুরির ঘটনায় তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্যরা জড়িত।
গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর বিভাগের ডিসি মানস কুমার পোদ্দার বলেন, কক্সবাজারকেন্দ্রিক যে গ্রুপটির খোঁজ মিলেছে, এদের মূল পেশা চুরি। এক জায়গায় বেশি দিন বাসা ভাড়া করে থাকেন না তারা। দামি ইলেকট্রনিকস জিনিসপত্র চুরি করাই তাদের নেশা। মধ্যম কোনাখালী ও আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে তরুণদের ঢাকায় এনে চোর চক্রে ঢোকানো হয়। তাদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৫-এর মধ্যে।
চোর চক্রের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য রাখছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার সালাউদ্দিন খান নাদিম। তিনি বলেন, কক্সবাজারে কলেজছাত্র খুনের পরই জড়িতদের ব্যাপারে ছায়াতদন্ত করে নোমান ও তাঁর গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলে।
চকরিয়ায় চোর চক্রের হাতে নিহত কলেজছাত্র জিহাদের বাবা মকছুদুল করিম বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরোকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই শোক কীভাবে ভুলব। ছেলের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’