ভারতে নেই চাকরি, কর্মীরা ছুটছেন ইসরায়েলে
হিমশীতল সকাল। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হরিয়ানার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শত শত পুরুষ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। সবার কাছে ব্যাকপ্যাক ও দুপুরের খাবারের ব্যাগ। সবাই চাকরির জন্য ভারত ছেড়ে ইসরায়েলে যেতে চান। ইসরায়েলে নির্মাণকাজে নিয়োগের জন্য প্লাস্টারিং শ্রমিক, স্টিল ফিক্সার ও টাইলস সেটারের ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল গত সপ্তাহে। এ পরীক্ষা দিতেই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা।
ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে আসা চাকরিপ্রার্থীদের একজন রঞ্জিত কুমার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন। পেশায় শিক্ষক। কিন্তু তিনি চিত্রশিল্পী, স্টিল ফিক্সার, শ্রমিক, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ টেকনিশিয়ান ও একজন জরিপকারী হিসেবে কাজ খুঁজে পেতে চান।
৩১ বছর বয়সী রঞ্জিত বলেন, দুটি ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও তিনি দিনে ৭০০ রুপির বেশি আয় করতে পারেন না। ডিজেল মেকানিক হিসেবে কাজ করার জন্য একটি সরকারি ‘বাণিজ্য পরীক্ষায়’ পাস করেছেন। এ ছাড়া ইসরায়েল আবাসন ও চিকিৎসার সুবিধাসহ প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার রুপি দিচ্ছে।
রঞ্জিত আরও বলেন, তাঁর পরিবারের সদস্য সাতজন। তাঁদের সহযোগিতা করতে হবে। গত বছর তিনি পাসপোর্ট পেয়েছেন। তিনি ইসরায়েলে ইস্পাত ফিক্সার হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, ‘এ দেশে কোনো নিরাপদ চাকরি নেই। পণ্যের দাম বাড়ছে। ৯ বছর আগে স্নাতক পাস করার পরও আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হতে পারিনি আমি।’
এ দেশে কোনো নিরাপদ চাকরি নেই। পণ্যের দাম বাড়ছে। ৯ বছর আগে স্নাতক পাস করার পরও আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হতে পারিনি আমি।
রঞ্জিত কুমার, ইসরায়েলে চাকরিপ্রার্থী
কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল নির্মাণ খাতকে সম্প্রসারণের জন্য চীন, ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে ৭০ হাজার কর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। এর জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল, যা এখনো চলছে। এই হামলার পর ইসরায়েল প্রায় ৮০ হাজার ফিলিস্তিনি শ্রমিককে নিষেধ করেছে। এ কারণে দেশটিতে শ্রমিকসংকট দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ইসরায়েল ভারত থেকে প্রায় ১০ হাজার কর্মী নিয়োগ দেবে। উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানা চাকরির আবেদন গ্রহণ করছে। হরিয়ানার রোহতক শহরের মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় সারা দেশ থেকে কয়েক হাজার আবেদনকারীর পরীক্ষার আয়োজন করছে। তবে এ বিষয়ে দিল্লিতে ইসরায়েল দূতাবাস কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে।
রঞ্জিতের মতো সারিতে থাকা চাকরিপ্রার্থীরা ভারতে আনুষ্ঠানিক চুক্তি ও কোনো সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই কাজ করেন। অনেকেরই কলেজ ডিগ্রি আছে, তবু তাঁরা নিরাপদ চাকরির জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। তাঁরা নির্মাণকাজের দিকে ঝুঁকছেন। মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ করেন। দিনে আয় হয় ৭০০ রুপির মতো।
উত্তর প্রদেশের অঙ্কিত উপাধ্যায় (মাঝে) ইসরায়েল যেতে পরীক্ষা দিতে এসেছেনছবি: এক্স থেকে নেওয়া
আয় বাড়ানোর জন্য অনেকে একাধিক কাজ করেন। কেউ কেউ নিজেদের এ পরিস্থিতির জন্য আর্থিক বিপর্যয়, ২০১৬ সালের মুদ্রা নিষেধাজ্ঞা ও করোনার সময়ের লকডাউনকে দায়ী করেছেন। আবার কেউ কেউ সরকারি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করেছেন। অনেকের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবৈধভাবে যাওয়ার জন্য এজেন্টদের অর্থ প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এই অর্থ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁরা বলছেন, এ সবই তাঁদের একটি নিরাপদ, আরও লাভজনক বিদেশি চাকরি খোঁজার জন্য প্ররোচিত করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার ঝুঁকির বিষয়টি তাঁরা কিছু মনে করছেন না।
রঞ্জিতের মতো আরেকজন চাকরিপ্রার্থী সঞ্জয় ভার্মা। ২০১৪ সালে স্নাতক পাস করেছেন। কারিগরি ডিপ্লোমাও আছে। পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী, রেলওয়েসহ এক ডজনের বেশি সরকারি পরীক্ষায় অংশ নিতে নিতে ছয় বছর পার করেছেন। ২০১৭ সালে ইতালিতে একটি খামারের কাজে প্রতি মাসে ৯০০ ইউরো বেতনের চাকরি হয়েছিল। কিন্তু এ জন্য এজেন্টকে ১ লাখ ৪০ হাজার রুপি দিতে না পারায় তাঁর ইতালিতে যাওয়া হয়নি।
আরেকজন চাকরিপ্রার্থী পারবত সিং চৌহান। তিনি বলেন, মুদ্রা নিষেধাজ্ঞা ও লকডাউনের ধাক্কায় তিনি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যান। ৩৫ বছর বয়সী চৌহান রাজস্থানে অ্যাম্বুলেন্সের চালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজের জন্য মাসে আয় ছিল ৮ হাজার রুপি।
শ্রমশক্তি সমীক্ষা থেকে পাওয়া সরকারি তথ্য বলছে, ভারতে বেকারত্ব হ্রাসের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালে ৬ শতাংশ থেকে ২০২১-২২ সালে তা ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
চৌহান বলেন, ‘অন্য অনেকের মতোই হাইস্কুল শেষে কাজের খোঁজে নেমে পড়ি। স্কুলে পড়ার সময় সংবাদপত্র বিক্রি শুরু করি। এতে মাসে ৩০০ রুপি আয় হতো। মায়ের মৃত্যুর পরপর কাপড়ের দোকানে কাজ নিই। আয় ভালো না হওয়ায় মুঠোফোন মেরামতের কোর্স করি। কিন্তু এতেও খুব একটি সুবিধা হয়নি।’ তবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত বছর তাঁর ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে। নিজে অ্যাম্বুলেন্স চালাতেন। গ্রামে ছোট ছোট নির্মাণকাজ পরিচালনা করতেন। কিছু ট্যাক্সি কিনে ভাড়া দিতেন। চৌহান বলেন, ‘কিন্তু লকডাউন আমাকে শেষ করে দিয়েছে। বন্ধক রাখার সামর্থ্য না থাকায় আমার গাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন আবারও আমি অ্যাম্বুলেন্স চালাই। সরকারের ছোট ছোট নির্মাণকাজে ফিরে এসেছি।’
হরিয়ানার ৪০ বছর বয়সী টাইলস সেটার রাম। দুই দশক ধরে তিনি এই কাজ করছেন। জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও স্থবির মজুরির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তাঁর মেয়ে বিজ্ঞানে স্নাতক করছেন। ছেলে চান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে। এসব কারণে তিনি দুবাই, ইতালি ও কানাডায় চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তবে এজেন্টদের দাবি করা অতিরিক্ত ফি দিতে পারেননি তিনি, তাই যাওয়া হয়নি। বাসাভাড়া, সন্তানদের কোচিং ও খাবারের খরচ—সব মিলিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন রাম।
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, ইসরায়েলে যুদ্ধ চলছে। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। এখানেও তো মরে যেতে পারি।’
এমন নয় যে চাকরি হচ্ছে না। এটা ঠিক যে সংগঠিত চাকরি কেবল বাড়ছে। আবার একই সময়ে চাকরি খুঁজছেন, এমন তরুণদের সংখ্যাও বাড়ছে।
সন্তোষ মেহরোত্রা, বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ
২৮ বছর বয়সী হর্ষ জাত ২০১৮ সালে মানবিক বিভাগে থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। শুরুতে তিনি একটি গাড়ির কারখানায় মেকানিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরে তিনি পুলিশের গাড়িচালক হিসেবে দুই বছর কাটিয়েছেন। এরপর গুরগাঁওয়ে পাব বাউন্সার হিসেবে কাজ করেছিলেন। এতে মাসে আয় হতো ৪০ হাজার রুপি। তিনি বলেন, ‘এসব কাজে কোনো নিরাপত্তা নেই। দুই বছর পরই চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেয়।’
হর্ষ জাত বলেন, চাকরি হারিয়ে তিনি পরিবারে ফিরে আসেন। তাঁর আট একর জমি আছে। কিন্তু এখন কেউ চাষ করতে চায় না। তিনি সরকারি চাকরি, কেরানি ও পুলিশের চাকরির চেষ্টা করেও সফল হননি। তিনি আরও বলেন, তাঁর গ্রামের তরুণেরা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবৈধভাবে যাওয়ার জন্য এজেন্টদের ৬০ লাখ রুপি করেও দিয়েছেন। তাঁরা এখন বাড়িতে অর্থ পাঠাচ্ছেন, গাড়ি কিনছেন।
হর্ষ জাত বলেন, ‘আমি বিদেশে যেতে চাই। ভালো বেতনের চাকরি পেতে চাই। কারণ, যখন আমার সন্তান হবে, তখন সে আমাকে জিজ্ঞাসা করবে, আমাদের প্রতিবেশীর এসইউভি গাড়ি আছে, আমাদের কেন নেই? যুদ্ধের কারণে আমি ভীত নই।’
আমার কোনো ভয় নেই। আমি ইসরায়েলে কাজ করতে চাই। সেখানে ঝুঁকি নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ, দেশে চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই।
অঙ্কিত উপাধ্যায়, ইসরায়েলে চাকরিপ্রার্থী
ভারতে কর্মসংস্থানে মিশ্র চিত্র দেখা যায়। শ্রমশক্তি সমীক্ষা থেকে পাওয়া সরকারি তথ্য বলছে, দেশে বেকারত্ব হ্রাসের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালে ৬ শতাংশ থেকে ২০২১-২২ সালে তা ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ সন্তোষ মেহরোত্রা বলেন, সরকারি তথ্যে অবৈতনিক কাজকে চাকরি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা এর জন্য দায়ী। তিনি বলেন, এমন নয় যে চাকরি হচ্ছে না। এটা ঠিক যে সংগঠিত চাকরি কেবল বাড়ছে। আবার একই সময়ে চাকরি খুঁজছেন, এমন তরুণদের সংখ্যাও বাড়ছে।
আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির সবশেষ স্টেট অব ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া প্রতিবেদন অনুসারে, বেকারত্ব কমছে। কিন্তু তারপরও কর্মসংস্থানের হার ওপরে আছে। ৮০-এর দশক থেকে স্থবির হওয়ার পর ২০০৪ সালে নিয়মিত মজুরি বা বেতনযুক্ত কাজে শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২৫ শতাংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়ে। ২০১৯ সালের পর থেকে ‘অর্থনৈতিক মন্দা ও মহামারি’র কারণে নিয়মিত মজুরির চাকরির গতি হ্রাস পেয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৫ শতাংশের বেশি স্নাতক এবং ২৫ বছরের কম বয়সী ৪২ শতাংশ স্নাতকদের জন্য মহামারির পর দেশে কোনো চাকরি ছিল না।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৫ শতাংশের বেশি স্নাতক এবং ২৫ বছরের কম বয়সী ৪২ শতাংশ স্নাতকদের জন্য মহামারির পর দেশে কোনো চাকরি ছিল না। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রম অর্থনীতিবিদ রোজা আব্রাহাম বলেন, ‘এই গোষ্ঠীর উচ্চ আয়ের আকাঙ্ক্ষা আছে। তারা অনিরাপদ কাজ করতে চায় না। এই গ্রুপ উচ্চ আয়ের জন্য [ইসরায়েলে যাওয়ার] চরম ঝুঁকি এবং কিছুটা কম অনিশ্চয়তার জন্য ব্যবসা করছে।’
এমন গ্রুপেরই একজন উত্তর প্রদেশের অঙ্কিত উপাধ্যায়। তিনি বলেন, তিনি এজেন্টকে অর্থ দিয়ে ভিসা পেয়েছিলেন। মহামারি চলাকালে চাকরি হারানোর আগে কুয়েতে আট বছর স্টিল ফিক্সার হিসেবে কাজও করেছিলেন।
‘আমার কোনো ভয় নেই। আমি ইসরায়েলে কাজ করতে চাই। সেখানে ঝুঁকি নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ, দেশে চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই’—এভাবেই বলেছেন অঙ্কিত।