Bangladesh

মূল্যস্ফীতির শঙ্কার মধ্যেই টাকা ছাপিয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

মূল্যস্ফীতি অনেক দেশে পড়তির দিকে থাকলেও, বাংলাদেশে এই চাপ কমার কোনো লক্ষণ নেই। এরমধ্যেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে টাকা ধার দিতে নতুন টাকা ছাড়ছে, যেটি মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেওয়ার একটি কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১৮ দিনের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, সরকারি ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাজস্ব ঘাটতির যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল আদতে ঘাটতি হয়েছে তারও বেশি, প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ার কারণে বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকার সরবরাহ বাড়াতে হয়েছে।

অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকার সরবরাহ

চলতি অর্থবছরের এসব তথ্য গত অর্থবছরের একই সময়ের সাথে তুলনা করলে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকখাত থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার ১২২ কোটি টাকা ধার নেয় সরকার। এরমধ্যে ৭৮ হাজার ১৪০ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মানে, প্রতিমাসে গড়ে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে।  এমনকি আগের অর্থবছরের শেষ মাস গত জুনেও সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৬ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা।    

সে তুলনায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১৮ দিনে – কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯১ ও ৩৬৪ দিন-মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা দিয়েছে। এছাড়া, আরও ৪ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা ২, ৫ ও ১০- বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ডিভলভিং প্রক্রিয়ায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে সরকারি ট্রেজারি বিল এবং বন্ড বিক্রি করে টাকা সংগ্রহের বদলে নিজেই কিনে নেয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিভলভমেন্ট কৌশলের আওতায় সরকারের টাকা ধার নেওয়ার অর্থ-  অর্থনীতিতে নতুন টাকার সরবরাহ বৃদ্ধি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকখাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ধার নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য আর্থিক ব্যবস্থার মনিটরিং অপরিহার্য

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির গুরুতর চাপ তৈরির হুমকি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কভাবে এসব আর্থিক ব্যবস্থাকে মনিটরিং করতে হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিভলভমেন্ট কৌশলের বিষয়ে মন্তব্য করেন বলেন, এর লক্ষ্য ট্রেজারি বিলের সুদহারকে কমিয়ে রাখা। ঋণের সুদহারের নতুন ফর্মুলা এক ধরনের সীমার মতোই কাজ করছে, কারণ ট্রেজারি বিলের ভিত্তি সুদহার বাজার-ভিত্তিক হচ্ছে না।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার মতে, ১৮২-দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড় সুদহার (স্মার্ট)-কে এখন ঋণের নতুন সুদহার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া, স্মার্টের সাথে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করে এখন থেকে প্রতি মাসে নতুন সুদহার ঘোষণা করবে ব্যাংকগুলো, যা চলতি জুলাই মাস থেকেই শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য স্মার্ট- নির্ধারণের জন্য একটা নিরপেক্ষ অবস্থান রাখা। এর কারণে জুলাই মাসে ১৮২- দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে ডিভলভমেন্ট করা হচ্ছে না বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

দেশের বিল ও বন্ড বাজার এখনো পরিণত হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অবস্থায় সুদহার ঠিক করার দায়িত্ব বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখানে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়ে যাবে।  

নাম না প্রকাশের শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিভলভমেন্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুদহারকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তবে সরকারকে এসব উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে চিন্তা করে ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। সেজন্যই ডিভলভমেন্টের মাধ্যমে সুদহারকে কিছুটা কমিয়ে রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংক।”

জুনের তুলনাই জুলাই মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার কিছুটা বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের থেকে ঋণ নিলে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে

টাকা ছাপানোকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বিপরীত পন্থা বলে মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

“২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতেই টাকা ছাপানোর ফলে পুরো অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধিতে তা কতোটা প্রভাব ফেলবে- এখনই তা বলা যাচ্ছে না। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুতে সরকার যে পন্থা অবলম্বন করেছিল এবারও সেই পথে হাঁটছে। এক্ষেত্রে কিছুই বদলায়নি”- বলছিলেন তিনি।

সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তাতে ব্যাংকখাতে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, “এতে বেসরকারি খাতকে ঋণ দেওয়ার মতো টাকা কমে যায়, আর সেটা ব্যবসায়ীদের জন্য সংকট সৃষ্টি করবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। যদিও এতে ভোক্তাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যায়।

নতুন করে এই বিশাল পরিমাণ টাকা ছাপানোর ফলে জুনে রিজার্ভ মানি ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, যা গত বছরের একই সময়ের নেতিবাচক ০.৩ শতাংশ থেকে বেড়েছে। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে ১৪ শতাংশের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, এটা তার চেয়ে অনেকটাই কম। তবে সুদহারের মাধ্যমে মুদ্রা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এজন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য রিজার্ভ মানি প্রবৃদ্ধির কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেনি।  

২০২২২-২৩ অর্থবছরে ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা প্রত্যাহার করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত সেকারণেই রিজার্ভ মানি প্রবৃদ্ধির হার কম হয়েছে।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বছরওয়ারি হিসাবে চলতি বছরের মে মাসে নেট স্থানীয় সম্পদ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬.১৭ শতাংশ। এসময় নেট বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক ১৫.২৮ শতাংশ।

সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন টাকা ছাপানোর ফলেই স্থানীয় সম্পদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে – যা মূল্যস্ফীতিকেও উস্কে দিতে পারে। সে তুলনায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক সম্পদের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মূলে ছিল বাজারে ডলার সরবরাহ বা বিক্রির বিপুল চাপ – যার অর্থ বৈদেশিক অর্থ পরিশোধের সক্ষমতা কমছে দেশের।

‘মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়তে পারে’

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ডিভলভমেন্টের কারণে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যেতে পারে। যদি ১ লাখ কোটি টাকা অর্থনীতিতে ঢোকানো হয়, তা পাঁচ লাখ কোটি টাকায় রূপ নেয়, কিন্তু সেটা একদিনে হয় না। এখন যে ডিভলভমেন্ট করা হচ্ছে, হয়তো এখন থেকে ছয় মাস বা ২-৩ বছর পরে মূল্যস্ফীতিতে তার প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ, গত বছরে সরকারকে ঋণ দিতে যত টাকা ছাপানো হয়েছে, ভবিষ্যতে আমরা তার পূর্ণ প্রভাব দেখব। একারণে জনগণকে মূল্যস্ফীতির চাপ বইতে হবে।”  

এই অবস্থায় সরকারকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।

‘দোষ চাপানো সহজ’

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, “২০২২-২৩ অর্থবছরের সময় বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি হার তীব্রভাবে কমতে শুরু করলেও বাংলাদেশে তা বাড়তেই থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম-সহ বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে স্থানীয় মূল্যস্ফীতি হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তারপরও জুনে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৭৪ শতাংশের মতোন উচ্চ। তাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির ঘাড়ে স্থানীয় মূল্যস্ফীতির দায় চাপানো রাজনৈতিকভাবে সুবিধেজনক হলেও, বাস্তবিকভাবে সেটা সঠিক নয়।”

তিনি আরও বলেন, যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি তীব্র হারে কমেছে, তারা বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্য হ্রাসের সুবিধা পেয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তারাও অর্থনীতিতে চাহিদা কমানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিল।

কিন্তু, বাংলাদেশ চাহিদা না কমিয়ে তার পরিবর্তে সুদহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চাহিদার প্রবৃদ্ধিকে উস্কে দিয়ে আর্থিক ঘাটতির মধ্যে পড়ে। তাই বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমার ফলেও দেশের মূল্যস্ফীতি কমেনি, –যোগ করেন সাদিক আহমেদ।  

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto