ভারতে নির্বাচনী বন্ড বিতর্ক: যেভাবে লাভবান হচ্ছে বিজেপি
ভারত ফের একটা সাধারণ নির্বাচনের সাক্ষী হতে চলেছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি রুপি খরচ হয়েছিল। কারও অজানা নয়, ভোটে লড়তে রাজনৈতিক দলের বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। বেশ কয়েক বছর আগে বাজেট পেশের সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মন্তব্য করেছিলেন, স্বাধীনতার ৭০ বছর পার হলেও দেশে রাজনৈতিক দলগুলির স্বচ্ছভাবে অর্থ সংগ্রহের কোনও ব্যবস্থা নেই। স্বচ্ছভাবে যাতে রাজনীতিতে অর্থের প্রবেশ ঘটে, সেজন্য ২০১৮ সালে ‘নির্বাচনী ঋণপত্র’ বা ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ চালু করা হয়।
প্রতি বছর জানুয়ারি, এপ্রিল, জুলাই এবং অক্টোবর মাসের ১০ দিন ‘দ্য স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’-র মাধ্যমে কোনও ভারতীয় নাগরিক এবং ভারতে নথিভুক্ত কোনও বাণিজ্যিক সংস্থার কাছে ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ বিক্রি করা যায়। কেনার ১৫ দিনের মধ্যে ক্রেতা তার পছন্দের কোনও রাজনৈতিক দলকে ওই ঋণপত্রটি হস্তান্তর করতে পারে এবং গ্রহীতা ওই বন্ড স্টেট ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে ক্রয়মূল্যের সমান অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। এই লেনদেনে– স্টেট ব্যাঙ্ক, আয়কর বিভাগ এবং গ্রহীতার রাজনৈতিক দলটি ছাড়া আর কেউ ক্রেতার পরিচয় জানতে পারে না। আগের ভোটে যে রাজনৈতিক দল ১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, তারা এই বন্ডের অনুদান নেয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
ইলেক্টোরাল বন্ডের প্রবক্তাদের বক্তব্য, আগে রাজনৈতিক দলগুলি ভোটের খরচ চালাত মূলত নগদে পাওয়া অনুদান থেকে, যার সিংহভাগই অবৈধ অর্থ। নতুন ব্যবস্থায় দলগুলি যেমন স্বচ্ছভাবে নির্বাচনে লড়ার অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে, তেমনই আবার ঋণপত্রলব্ধ টাকা স্বচ্ছভাবে খরচও করতে পারছে। তাছাড়া আয়কর বিভাগের কাছে প্রতিটি ঋণপত্র কেনাবেচার হিসাব থাকছে। অন্যদিকে, যেহেতু বন্ড যারা কিনছে, তার সম্পর্কে গ্রহীতা এবং আয়কর কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কেউ কিছু জানতে পারছে না, ফলে ওই ব্যক্তি বা সংস্থা নির্ভয়ে পছন্দের দলকে অর্থসাহায্য করতে পারছে। অর্থাৎ, যে সমস্ত দলকে অর্থ দেয়া হল না, দাতাদের সেসব রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে কোনওরকম রোষের মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে না। গণতন্ত্রে এই স্বাধীনতা ইতিবাচক বলে মনে করছেন নির্বাচনী বন্ড সমর্থকরা।
কিন্তু বিষয়টা আদৌ এতটা সরল নয় বলেই ইলেক্টোরাল বন্ডের বিরোধীদের দাবি। সমালোচকদের অভিযোগ, এই নির্বাচনী বন্ড মূলত ক্ষমতাসীন দলের কোষাগারকেই পুষ্ট করেছে। তাছাড়া, অতীতে দেখা গিয়েছে, এই ঋণপত্র মূলত কর্পোরেট সংস্থারাই কিনছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, তারা আদৌ আদর্শগত কারণে কিনছে না কি সুবিধা পাওয়ার লোভে? যেহেতু বর্তমান নিয়ম অনুসারে, এই লেনদেনের বিষয়ে সাধারণ ভোটার কিংবা বিরোধী দলগুলি জানতে পারছে না, সেহেতু এই অনুদানের পিছনে কোনওরকম অন্যায় সুবিধা কর্পোরেট পাচ্ছে কি না, তা-ও অজানা থেকে যাচ্ছে। এমন আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। চাইলে শাসক দল সহজেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে কম সুদে ঋণ অথবা কর এবং শুল্ক ইত্যাদিতে ছাড়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারে কর্পোরেটদের। অর্থের বিনিময়ে এমন অন্যায় সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তা জনগণ জানতে পারলে ও জনমত তৈরি হলে ভোটে শাসকের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার হতে পারত। ফলে গোপনীয়তাটা এই বন্ডের গুণ নয়, দুর্বলতা।
আবার কোনও কর্পোরেট এ বন্ড মারফত বিরোধী দলকে কিছু দিলে ক্ষমতাসীন দলের সেই তথ্য জেনে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারণ, স্টেট ব্যাঙ্ক ও আয়কর বিভাগ, অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীন। শাসকের তেমন সুযোগ থাকলে আর ক’টা কর্পোরেট সংস্থা বিরোধী দলে টাকা দিতে সাহস দেখাবে? তাদেরও তো রাজরোষের ভয় আছে। অনেক সংস্থা ভুয়া কোম্পানি খুলে সেখানে অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ রেখে দেয়। সেখান থেকে অর্থ নিয়ে ইলেক্টোরাল বন্ড ক্ষমতাসীন দলকে দিলে কেউ জানবে না। অথচ তা বিরোধী কোনও দলকে দিলে শাসক তখন বিবিধ কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে সেই ভুয়া কোম্পানি এবং সংশ্লিষ্ট দলকে হয়রানির মুখে ফেলতেই পারে। অর্থাৎ, এ এক জটিল সমস্যা। সমাধানের পথ কোথায়?
নির্বাচনী ঋণপত্র তুলে দিলে রাজনৈতিক দলগুলি স্বচ্ছভাবে অর্থ সংগ্রহ করবে কী করে? উল্টোদিকে, গোপনীয়তার শর্ত কেমনভাবে বদলানো সম্ভব, যাতে সমস্যামুক্ত হওয়া যায়? একসময় নির্বাচন কমিশন ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিল, তারা এই নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পের বিরুদ্ধে না হলেও, এটি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামে অনুদানের অনুমোদন দেয়নি। অন্যদিকে এই প্রকল্পের সমালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, এ বন্ডগুলি ভারতীয় নোটের প্রতি জনবিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করবে এবং অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করবে।
নির্বাচনী বন্ড মামলায় রায়দান করল সুপ্রিম কোর্ট। আর তাতে ধাক্কা খেল নরেন্দ্র মোদী সরকার। শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, ২০১৮ সালে মোদী সরকারের জারি করা নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প পুরোপুরি অসাংবিধানিক। তার ফলে অনুদান দেওয়া সংস্থার নাম সামনে আসবে।