আসছে ‘ক্রলিং পেগ’ ॥ ডলার সংকট কাটাতে
ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, কোস্টারিকা এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে
দেশে প্রায় দুই বছর ধরে ডলার-সংকট চলছে। এই সংকটের কারণে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। তবে বর্তমানে বাজারে লেনদেন হচ্ছে ১২৪ টাকারও বেশি দামে। ডলার-সংকটে চাহিদামতো পণ্য আমদানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। আবার বিদেশী কোম্পানিগুলো মুনাফাও নিজ দেশে নিতে পারছে না। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চলতি অর্থবছরেই রিজার্ভ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভও কমছে। ডলারের এমন নানামুখী সংকটে দাম নিয়ন্ত্রণ ও বাজারভিত্তিক করতে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করা হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে উচ্চ বিনিময় হারের অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময় দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের হুমকি এড়াতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে ‘ক্রলিং পেগ’। তবে মুদ্রাবাজার সংকট কেটে গেলে এই পদ্ধতি কার্যকর থাকে না।
জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ডলার বিক্রি বন্ধের কথা জানালেও চলতি অর্থবছরেই রিজার্ভ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রায় ২৭ শতাংশ কমেছে। একাধারে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবমূল্যায়নের সুযোগ নিয়ে বিশেষ গোষ্ঠী ও কিছু এক্সচেঞ্জ হাউস কম দামে কেনা ডলার মজুত করে বেশি দামে বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করছে।
আবার প্রবাসীদের একটা অংশও বিলম্বে ডলার দেশে পাঠাচ্ছে। বিষয়টি এমন হয়েছে, ডলার যত বিলম্বে বাজারে ছাড়া হবে তত বেশি রেট পাওয়া যাবে। মানুষের এমন প্রত্যাশা থেকে বের হওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফায় ডলারের দাম কমিয়েছে এবং বাড়িয়েছে। ডলারের বাজার অস্থিরতার নেপথ্যে সম্ভাব্য নানা বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা দেওয়ার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর আগে ডলারের দাম নির্ধারণে সাময়িক ভিত্তিতে ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করা হবে।
বলা হয়, এই পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ডলারের দাম ওঠানামা করবে। সাধারণত ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়; হার্ড পেগ এবং সফট পেগ। হার্ড পেগ পদ্ধতিতে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার মান নিজে ঠিক করে দেয় এবং সে অনুযায়ী লেনদেন হয়। আর সফট পেগ পদ্ধতিতে বাজারের ওপরে মুদ্রার মান ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে সরকার বা ব্যাংক চাইলে সফট পেগ পদ্ধতিতে ডলারের একটি সম্ভাব্য দাম ধরে দিতে পারে। এ ছাড়া অনেক দেশে ডলারের মান সম্পূর্ণ বাজারমুখী রাখতে এবং হস্তক্ষেপবিহীন মান নির্ধারণে ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট’ ব্যবহার করা হয়।
এতে বাজার ও অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের দাম ওঠানামা করে। এসব পদ্ধতির বাইরে অর্থনীতিতে নিজ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করলে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ণয় করা হয়। ‘ক্রলিং পেগ’ হচ্ছে দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনি¤œ সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে ডলারের দর নির্ধারণে বিশেষ দল কাজ করছে। মূলত ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে আইএমএফের সঙ্গে অনলাইনে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আলোচনা করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইছে ডলারের দাম ১১০ থেকে ১১২ টাকার মধ্যে রাখতে এবং সে ব্যাপারেই আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে সফটওয়্যার আপডেট করতে আইএমএফের একটি কারিগরি প্রতিনিধি দল আগামী সপ্তাহেই ঢাকা আসছে। তারা ক্রলিং পেগ চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে সহায়তা করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, কোস্টারিকাসহ কিছু দেশ এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে। নতুন পদ্ধতি টাকার বিপরীতে ডলারের দামের ভিত্তি হবে রিয়াল ইফেকটিভ এক্সচেঞ্জ রেট (রিয়ার) ও নমিনাল ইফেকটিভ এক্সচেঞ্জ রেট (নিয়ার)। বৈশ্বিক মানদ-ের আলোকে ‘ক্রলিং পেগ’ রেটের সঙ্গে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকার করিডর রাখা হবে। আর স্মার্ট সুদহারের আলোকে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ডলারের দর নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের খরচ মেটাতে ডলার বিক্রি করা হয়।
এটা দেশের বৃহৎ স্বার্থেই করা হচ্ছে। যখন ব্যাংকগুলোর পর্যাপ্ত ডলার থাকবে, তখন ডলার বিক্রি করা হবে না। প্রয়োজনে কেনা হতে পারে। যেমন করোনার পরে ডলার ক্রয় করা হয়েছিল।’ ডলারের বাজারে এই অস্থিরতা প্রশমনে ক্রলিং পেগ কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, ডলার সংকটের মূল কারণ উদঘাটন না করে শুধু ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে বাজারে ভারসম্য আনা অসম্ভব।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে টাকার লাগাতার অবমূল্যায়নের কারণে দেখা গেছে ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ বা মুনাফা মিলিয়ে যা লাভ হয়, শ্রেফ টাকাকে ডলারে রূপান্তর করলে তার থেকে বেশি লাভ হয়। টাকা এবং ডলারের এ ব্যবধান কমিয়ে না আনলে কোনোভাবেই ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কাজে আসবে না। আগে ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে, পরে পদ্ধতি কাজে আসবে কিনা সেটি নিয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারিত হচ্ছে। তাদের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ডলারের সর্বোচ্চ দর ১১০ টাকা বেঁধে দেওয়া হলেও ওই দরে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে খুবই কম। বরং ১২২ থেকে ১২৪ টাকা দামেও আমদানিতে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে।