৪ কোটি কিডনি রোগী ডাক্তার ৩৬০
দেশে প্রতি বছর বাড়ছে কিডনি রোগের প্রকোপ। কমছে পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুযোগ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ কোনো না কোনো কিডনির জটিলতায় ভুগছেন। এর বিপরীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেফ্রোলজিস্ট আছেন মাত্র ৩৬০ জন। আর ডায়ালাইসিস সেন্টারের সংখ্যা ২৫০ থেকে ২৬০টি। অপ্রতুলতা চিকিৎসাব্যবস্থা ও চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় মোট কিডনি রোগীর ৯০ শতাংশই থাকছেন চিকিৎসাসেবার বাইরে। দেশে এ বিপুলসংখ্যক মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হলেও কিডনি চিকিৎসার নাজেহাল অবস্থা।
যদিও দেশে কত মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত, তার নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। দেড় দশক আগে কিডনি ফাউন্ডেশন সাভারের বিরুলিয়া গ্রামে ও কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) টাঙ্গাইলে দুটি পৃথক জরিপ চালায়, উভয় জরিপ থেকেই জানানো হয়েছিল দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা দুই কোটি। এরপর দেশে আর কোনো জরিপ হয়নি। প্রতি বছর কিডনি রোগীর সংখ্যা একই বলে জানানো হচ্ছিল। তবে বছর দুই আগের একটি গবেষণা প্রবন্ধের তথ্য উদ্ধৃত করে সরকারের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক রোবেদ আমিন সম্প্রতি ক্যাম্পসের একটি অনুষ্ঠানে বলেন, কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছেন, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ। এর মধ্যে বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর হার শতকরা ১৬-১৮ ভাগ। এ চিকিৎসা এতটাই ব্যয়বহুল যে, শতকরা ১০ জন রোগী তা বহন করতে পারে না। ফলে প্রায় ৯০ ভাগ রোগী বিনা চিকিৎসায় অথবা আংশিক চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বে ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ লাখের বেশি কিডনি বিকল রোগী সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করবে। বর্তমানে ৮৫ কোটির অধিক মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ আকস্মিক কিডনি বিকল রোগে আক্রান্ত হয়, যার ৮৫ ভাগই উন্নয়নশীল দেশে।
কিডনি চিকিৎসক ও কিডনি চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রমতে, ৩ কোটি ৮০ লাখ রোগীর বিপরীতে নেফ্রোলজিস্ট মাত্র ৩৬০ জন, বিশেষজ্ঞ নার্স ২০০ ও ডায়ালাইসিস সেন্টারের সংখ্যা ২৫০-২৬০টি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ৫০ হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একজন নেফ্রোলজিস্ট থাকা দরকার। এই হিসাবে ১৭ কোটি মানুষের দেশে নেফ্রোলজিস্ট প্রয়োজন ৩ হাজার ৪০০। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা পেলে অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠতেন।
দেশে ২৫০টির বেশি ডায়ালাইসিসের সেন্টারের মধ্যে সরকারি ডায়ালাইসিস সেন্টারের সংখ্যা ৪৫টি। বিশিষ্ট কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক হারুন আর রশিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যাদের কিডনি বিকল হয় তাদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়, অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। দেশে যে ডায়ালাইসিস সেন্টার আছে তা দিয়ে ১০-২০ ভাগ রোগীকে ডায়ালাইসিস দেওয়া যায়। এ ডায়ালাইসিস আবার এতটাই ব্যয়বহুল যে, ৯০ ভাগ রোগীই ছয় মাসের মধ্যে চিকিৎসার খরচ বহন করতে না পেরে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন।
দেশে ডায়ালাইসিস সেন্টারের প্রয়োজন কতটি এমন প্রশ্নের জবাবে ক্যাম্পসের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা যদি ন্যূনতম সুবিধাও দিতে চাই তাহলে কমপক্ষে এক হাজার ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে তুলতে হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয় যাদের ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয় এর সঙ্গে আগে থেকে কিডনি বিকল রোগীর সংখ্যা যুক্ত করলে এর সংখ্যা অনেক বেশি। সরকারি ও বেসরকারি ডায়ালাইসিস সেন্টারগুলোতে দিনে ১৫ হাজারের মতো মানুষকে ডায়ালাইসিস দেওয়া সম্ভব হয়। বাকি রোগীরা থেকে যান ডায়ালাইসিস সুবিধার বাইরে। চিকিৎসকদের মতে, দেশে হিমোডায়ালাইসিস ও পেরিটোনিয়াল এ দুই ধরনের ডায়ালাইসিস চিকিৎসা রয়েছে। কী ধরনের ডায়ালাইসিস কার জন্য প্রযোজ্য হবে তা নির্ভর করে রোগীর ওপর।
সরকারের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘দেশে কিডনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ডায়ালাইসিস সেন্টারসহ কিডনি চিকিৎসার সুযোগ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই যৎসামান্য। তাই দেশের কিডনি চিকিৎসার চিত্র খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কিডনি চিকিৎসা সম্প্রসারণের ডায়ালাইসিস সেন্টার বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের ভাবনায় আছে।’
কিডনি রোগ বাড়ার কারণ : খাদ্যে ভেজাল, খাবারে অতিরিক্ত লবণ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ব্যায়াম না করা, ফাস্টফুড ও পানীয় আসক্তি, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন এবং অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ মাত্রাতিরিক্ত সেবনের কারণে আমাদের দেশে কিডনি রোগে বেশিরভাগ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। যাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে, তারা সবচেয়ে বেশি কিডনি রোগের ঝুঁকিতে থাকেন। যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে তাদের প্রস্রাবের সঙ্গে অ্যালবুমিন যেতে যেতে কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। এর বাইরে খুব বেশি ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি বা রক্তক্ষরণ হলেও কিডনির সমস্যা হতে পারে।
বাংলাদেশ নেফ্রোলজি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনোয়ার হুসেন বলেন, ‘১৬ দশমিক ২ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় নির্দিষ্ট সময়ের আগে। ফলে এ শিশুগুলো কিডনি রোগে আক্রান্ত হয় বেশি। ১ শতাংশ শিশু কিডনিতে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়। মাকে ঠিকমতো চিকিৎসা দেওয়া হলে এ সমস্যা কেটে যাবে। শিশু বয়স থেকে প্রতিরোধ করতে হবে। বাচ্চারা যত সল্টি খাবার খায়, ফাস্টফুড খায়, তাদের তত বেশি কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। বাচ্চাদের খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে এরাই বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি ঝুঁকিতে পড়বে।’
অধ্যাপক ডা. সামাদ বলেন, ‘তীব্রমাত্রার ব্যথার ওষুধ পরিহার করার মাধ্যমে আমরা কিডনি রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বেশি, বংশে কিডনি রোগ আছে, যারা ধূমপায়ী তাদের বছরে অন্তত দুবার প্রস্রাব ও রক্তে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। কেননা প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট : দেশের কিডনি চিকিৎসায় একমাত্র বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান রাজধানীর জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট। এ ইনস্টিটিউট নানা সংকটে ভুগছে। কিডনি রোগীদের চাপ সামলাতে ১৫০ শয্যার এ ইনস্টিটিউটকে ২০২২ সালে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করলেও ডাক্তার, নার্স, টেকনেশিয়ান, কর্মকর্তা-কর্মচারী বাড়ানো হয়নি। ফলে আগের জনবল দিয়েই এর চিকিৎসাসেবা চলছে। গত রবিবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের দীর্ঘ সারি। হাসপাতাল ঘুরে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ রোগীর কেউ বহির্বিভাগে চিকিৎসা করাতে এসেছেন, কেউ এসেছেন দীর্ঘদিনের কিডনি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আশায়। রোগীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ভিড় করেছেন সরকারি এ হাসপাতালে কম টাকায় ডায়ালাইসিস করাতে।
হাসপাতালের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, এ হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে সরকারের মন্ত্রী, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা কিংবা ক্ষমতাশীল কারও তদবির প্রয়োজন হয়। না হলে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও শয্যা পাওয়া যায় না। রোগীর চাপ এত বেশি যে, একটা সিটের বিপরীতে ১০-১৫ জন অপেক্ষায় থাকেন। বহির্বিভাগে যে রোগী চিকিৎসা পান তার চেয়ে চারগুণ বেশি রোগী চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান। প্রতিদিন প্রায় ১০০ রোগী আসেন যাদের ভর্তি হওয়া খুব প্রয়োজন, কিন্তু দিনে শয্যা খালি হয় তিন-চারটা। এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি হওয়ার পর এক-দেড় মাস থাকতে হয়, ফলে শয্যা খালি হয় না।
রফিকুল ইসলাম নামে এক রোগী বলেন, ‘১৫ দিন ধরে ঘোরাঘুরি করছি, কিন্তু ভর্তি হতে পারছি না। কবে যে ভর্তির সুযোগ পাব তা জানি না।’
হাসপাতালের দ্বিতীয়তলায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তির আওতায় স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসের মাধ্যমে ডায়ালাইসিস দেওয়া হচ্ছে। ডায়ালাইসিস কক্ষের সামনে কথা হয় আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডাক্তার বলেছেন সপ্তাহে দুদিন ডায়ালাইসিস নিতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করানোর সামর্থ্য নেই। তাই এখানে প্রতিদিন আসি যদি সিরিয়াল পাই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বলেন, এখানে একবার যে ডায়ালাইসিসের সুযোগ পান, তিনি যদি মারা না যান কিংবা আর্থিক সমস্যার কারণে ডায়ালাইসিস বন্ধ না করেন, তাহলে নতুন কাউকে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। ডায়ালাইসিস তো একবার করালেই শেষ এমন নয়, এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ডায়ালাইসিস দিয়েও চাপ সামলানো যায় না।
স্যানডোরের তথ্য অনুযায়ী, এই ইনস্টিটিউটে তাদের ৫৯টি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে। এই মেশিন দিয়ে বছরে ৮৬ হাজার ১৪০টি সেশন করা যায়। প্রতিটি সেশনে সরকার ভর্তুকি দেয় ২ হাজার ৪০০ আর রোগী দেন ৫৩৫ টাকা। এর মধ্যে ১৩ হাজার সেশনে সরকার ভর্তুকি দেয়। বাকি সেশনে রোগীকেই পুরোটা বহন করতে হয়। সে ক্ষেত্রে রোগীর খরচ পড়ে প্রতি সেশনে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা।