USA

যুক্তরাষ্ট্রে ২৩ বছরে সুদের হার সর্বোচ্চ, অর্থনীতিতে মন্দা নেই কেন

গতকাল মঙ্গলবার থেকে ফেডারেল রিজার্ভের মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠক শুরু হয়েছে। গত দুই বছর আগ্রাসীভাবে নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে তা এখন গত ২৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার এখন কম; সে দেশের শেয়ারবাজার একের পর এক রেকর্ড গড়ছে। মন্দার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না মার্কিন অর্থনীতিতে।

এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদেরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন।

অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে, ফেডারেল রিজার্ভ বা বিশ্বের যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো, মন্দার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া। এর আগে সুদহার বৃদ্ধির কারণে মার্কিন অর্থনীতি চাপে পড়েছিল; কিন্তু এবার তেমন কোনো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না।

সিএনএন জানিয়েছে, সুদহার বেশি থাকার পরও মার্কিন অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অংশত এর কারণ হলো, মহামারির সময় বাড়ির মালিকেরা যে অতি নিম্ন হারে বন্ধক রেখে পুনঃ অর্থায়নের সুবিধা পেয়েছিলেন, সেটা। ফেডারেল রিজার্ভ তখন বন্ধকের সুদহার প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছিল। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে মার্কিন নাগরিকদের আর্থিক ভিত্তি নানাভাবে শক্তিশালী হয়েছে, সে কারণে তাদের হাতে এখন সঞ্চয় আছে এবং খুব একটা ঋণ করতে হচ্ছে না।

গত মাসে সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেছিলেন, গত দুই বছর আগ্রাসীভাবে নীতি সুদহার বাড়ানো দরকার ছিল, এমনকি তাতে মার্কিন নাগরিকদের কিছু ক্ষতি হলেও।

জেরোম পাওয়েল সেদিন আরও বলেন, মার্কিন নাগরিকদের ক্ষতি হলেও নীতি সুদহার আগ্রাসীভাবে বাড়াতে হবে—এ কথা বলে তিনি সততার পরিচয় দিয়েছিলেন।

এর আগে যতবার নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, ততবার একই কাণ্ড ঘটেছে, কিন্তু এবার তা হয়নি। অর্থনীতিবিদেরা বিস্মিত হলেও তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মার্কিন নাগরিকেরা মন্দার কবলে পড়েননি।

মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল হাতিয়ার হলো নীতি সুদহার নির্ধারণ। এই সুদহারের দ্বারা ঋণের সুদহার নির্ধারিত হয়। অর্থনীতির গতি কমানোর প্রয়োজন হলে ফেড বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই হাতিয়ার প্রয়োগ করে, অর্থাৎ নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরে।

মার্কিন নাগরিকদের বাড়ি কেনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হলো বন্ধকি ঋণ; এই ঋণের সুদহার ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রিত হয়। এই বন্ধকি ঋণের মধ্য দিয়ে নীতি সুদহার বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আগে তা যেভাবে কাজ করত, এবার তা হয়নি।

আলিয়ানজ ট্রেডের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড্যান নর্থ সিএনএনকে বলেন, মহামারির সময় মানুষ স্বল্প সুদে বন্ধকি ঋণ নিয়ে বাড়ি কিনেছে; এসব ঋণ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি—১৫ থেকে ৩০ বছরের জন্য। গত দুই বছরে নীতি সুদহার বাড়লেও এসব মানুষের বন্ধকি ঋণের সুদহার বাড়েনি। তাঁরা বরং নীতি সুদহার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্বাগত জানিয়েছেন; কারণ নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার কমেছে, তাঁদেরসহ সবার জীবনযাত্রার ব্যয় কমেছে।

কোভিড-১৯ মহামারির শুরুতে ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার হ্রাস করে অর্থনীতিকে চাঙা করার চেষ্টা করে। সেই সময় অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যাওয়ার কারণে বেকারত্বের হারও বেড়ে গিয়েছিল। নীতি সুদ হ্রাসের প্রভাবে তখন বন্ধকি ঋণের সুদহারও কমেছিল। তখন মানুষ বাড়ি না কিনলেও ২০২১ সালে অর্থনীতি চাঙা হলে মানুষ তখন স্বল্প সুদে বাড়ি কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

২০২১ সালে মার্কিন নাগরিকেরা ৩ শতাংশ সুদে বন্ধকি ঋণ নিয়েছিলেন; এখন যার গড় সুদহার ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে বন্ধকি ঋণের সুদহার ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। এখন এই হার কমলেও ২০০৮ থেকে ২০২২ সালে তা যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশি।

সিএনএনের সংবাদে বলা হয়েছে, বন্ধকি ঋণের এই অতি নিম্ন সুদহার বাড়ির ক্রেতাদের জন্য একধরনের সোনালি হাতকড়ার মতো। সে জন্য তাঁরা এখন বাড়ি বিক্রি করতে চাচ্ছেন না; বা এমনকি প্রয়োজন হলেও করবেন না।

গত ডিসেম্বর মাসের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ফেডারেল রিজার্ভ জানায়, এ বছর তিনবার নীতি সুদহার কমানো হতে পারে। আজ বুধবার তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানা যাবে।

পারিবারিক স্থিতি শক্তিশালী

ফেডারেল রিজার্ভ যখন নীতি সুদহার বাড়াতে শুরু করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাদের আর্থিক পরিস্থিতি বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। ২০২০ ও ২০২১ সালে মহামারির প্রভাব মোকাবিলায় মার্কিন সরকার নাগরিকদের বিপুল প্রণোদনা দেয়। কিন্তু বিধিনিষেধের কারণে তারা বাইরে তেমন একটা যেত না; এই অর্থ তখন তেমন একটা ব্যয়ও হয়নি।

২০২১ সাল থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জনবল নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। বেকারত্বের হার ৪ শতাংশের নিচে; বেড়েছে মজুরিও।

এসব কারণে নীতি সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। অর্থনীতি যে শুধু নিয়মের নিগড়েই চলে না, এটা তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। পূর্বাপর আরও অনেক কিছুর ওপর তা নির্ভর করে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button