২৫ হাজারে চিকিৎসকের সংসার!
‘হাসপাতালে রোগীদের সার্বক্ষণিক সেবা দিই আমরা। স্যাররা ডিউটিতে আসেন, দিকনির্দেশনা দেন, বাকি সময় আমাদেরই রোগী সামলাতে হয়। চেষ্টা করি সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার। সারা দিন কাজ করে যখন বাসায় ফিরি তখন আমাদের চিন্তা হয় বাসা ভাড়ার টাকা নিয়ে, খাবার কেনার টাকা নিয়ে, বাড়িতে বাবা-মাকে টাকা পাঠানো নিয়ে। এ চিন্তা যখন সার্বক্ষণিক তখন বড় চিকিৎসক হব কীভাবে?’ কাছে এমন কথাই বলেন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসক ডা. বিজন সেন।
তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসকের ভাতা মাসে ২৫ হাজার টাকা মাত্র। আমরা ডা. পদবিধারী, এমবিবিএস পাস করে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার জন্য কাজ করছি। আমাদের সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী যে ভাতা দেওয়া হয় তা খুবই কম। একজন শ্রমিকের বেতনও এর চেয়ে বেশি। এ ভাতা দিয়ে আমাদের নিজেদের খরচই চালানো যায় না; পরিবারকে, সংসারকে কী দেব!’
ইন্টার্ন চিকিৎসকদেরও একই অবস্থা। দেশে সাড়ে সাত হাজার পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসক আছে। আর ইন্টার্ন চিকিৎসক আছে চার হাজারের কিছু বেশি, যারা ভাতা পান মাসে ১৫ হাজার টাকা। গত ৯ মাস ধরে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনিদের ভাতা বন্ধ রয়েছে আর ইন্টার্নদের ভাতা বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ইউনিটের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ অর্থবছরে স্বাস্থ্য বাজেটের অব্যবহৃত ৬৭ শতাংশ অর্থ ফেরত পাঠানো হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের বরাদ্দের ২৯ শতাংশ খরচ হয়নি। সেবার ৬ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, বাকি টাকা ফেরত গেছে। অথচ ভবিষ্যতের চিকিৎসকরা মানবেতর জীবনযাপন করছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের দাবি যৌক্তিক। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে সময় লাগবে। আমি দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র তিন মাস, আগের অনেক বিষয় আমার জানা নেই। তাদের ভাতা বাড়বে, শুধু আমাকে আরেকটু সময় দিতে হবে।’
পোস্টগ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে যারা এমডি-এমএস করছেন তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও যারা এফসিপিএস করছেন তারা বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) অধিভুক্ত। তারা বিএসএসএমইউর অধীনে ১২টি প্রতিষ্ঠানের রেসিডেন্ট (আবাসিক) ও নন-রেসিডেন্ট (অনাবাসিক) চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ট্রেইনিদের ও ইন্টার্নদের ভাতা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৫০ ও ৩০ হাজার টাকা করা, বকেয়া ভাতা পরিশোধ, বিএসএসএমইউর অধীনে ১২ প্রতিষ্ঠানের রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের ভাতা পুনরায় চালু ও চিকিৎসক সুরক্ষা আইন পাসের দাবিতে ২৪ মার্চ থেকে কর্মবিরতি শুরু করেছেন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। ২৩ মার্চ চার দফা দাবিতে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন করেন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে দেখা করে তাদের দাবির কথা জানান।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২৪ মার্চ আন্দোলনকারীদের তার কার্যালয়ে ডেকে কথা বলেন। তবে তিনি দাবি কবে মানা হবে এবং ভাতা কত বাড়ানো হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি। গত বৃহস্পতিবার আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে কর্মবিরতি কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন আন্দোলনকারীরা।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক দুলাল বলেন, ‘ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা যে ভাতা পায়, সরকারি অফিসের একজন পিয়নও তার চেয়ে বেশি বেতন পায়। এটা রীতিমতো হাস্যকর ও অমানবিক। তাদের দাবি মেনে গ্রহণযোগ্য ভাতা নির্ধারণ করা হোক।’
পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. জাবির হোসেন বলেন, ‘আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। দেশের চিকিৎসা খাত যে এগিয়ে গেছে এর পেছনে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অবদান কম নয়। অথচ আমাদের সামান্য ভাতা দেওয়া হয় তাও আবার ৯ মাস ধরে বন্ধ। এটা শ্রম আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমাদের জীবন যেন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে সে পরিমাণে ভাতা দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসকদের গড় বয়স ২৮ থেকে ৩৬ বছর। নারী চিকিৎসক প্রায় ৯০ ভাগ; পুরুষ চিকিৎসকদের ৫০-৬০ ভাগ বিবাহিত। দুই রুমের একটা বাসা বিভাগীয় শহরে ভাড়া নিতে হলে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। প্রতি মাসে বই-খাতা ও বিভিন্ন ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট কিনতে হয়। কিছুদিন পরপর বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নিতে হয় যেখানে রেজিস্ট্রেশন ও গাড়িভাড়া বাবদ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সংসার খরচও এর সঙ্গে যোগ করতে হবে। ২৫ হাজার টাকা দিয়ে একজন চিকিৎসককে কীভাবে চলবে?’
তিনি বলেন, ‘ভারতে ট্রেইনি চিকিৎসককে মাসে ১ লাখ ২০ হাজার ও পাকিস্তানে দেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা। আমাদের ভাতা ৫০ হাজার টাকা করতে হবে।’
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা। সর্বশেষ আন্দোলনের মুখে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েটদের ভাতা ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়। ট্রেইনি চিকিৎসকরা ২৫ হাজারে রাজি ছিলেন না; কিন্তু তাদের বলা হয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে ভাতা বাড়ানো হবে। কিন্তু ভাতা তো বাড়েইনি, উল্টো জুলাই থেকে যে ভাতা বেড়েছে তা তারা এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে পাচ্ছেন। বারবার ধরনা দিয়েও বকেয়া টাকা এখনো পাননি।
হাসপাতালে রোগী ভর্তির পর তাদের রিসিভ করেন ও প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ ও চিকিৎসা দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। ইনডোর রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মূল দায়িত্ব পালন করেন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনিরা। সিনিয়র চিকিৎসকদের নির্দেশনা অনুসরণ করে তারাই সার্বক্ষণিক রোগীদের সেবা করেন। চিকিৎসা জরুরি সেবা। বছরে ৩৬৫ দিন ও দিনে ২৪ ঘণ্টা ইন্টার্ন ও ট্রেইনি চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা দেন। পোস্টগ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকরা সাধারণত দুই থেকে পাঁচ বছর উচ্চশিক্ষার প্রশিক্ষণ নেন। অন্যদিকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ইন্টার্নশিপের মেয়াদ এক বছর।
ইন্টার্ন চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন যৌক্তিক। আমরা দিনরাত খাটি আবার পড়াশোনাও করি। ৩০ হাজার টাকা ভাতা দিলে আমরা সব খরচ মিটিয়ে চলতে পারব।’