অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং, সারা দেশে ১৮০ গ্রুপ, নেতাদের ছত্রছায়ায় চলছে অপকর্ম
অপরাধ সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এরা রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলছে ১৮০টি গ্রুপ। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে সংঘটিত হচ্ছে তাদের কার্যক্রম। এরা ফেসবুকে, দেয়ালে বা পোস্টারে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে নিজেদের গ্রুপের নাম জানান দিচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনোখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে। এসব কিশোর মাদক-ব্যবসা ও দখলবাজিসহ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অধিকাংশ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নানা অপরাধে জড়িয়ে কিশোররা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। হিরোইজম প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা
খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় বড় ভাইয়েরা। প্রথমে তুচ্ছ এবং পরে বড় অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং কালচার সারা দেশে ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে সারা দেশের কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় নিহত হয়েছেন ২৬ জন এবং আহত হয়েছেন ৩২৯ জন। কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৭৯টি এবং গ্রেফতার হয়েছে ৯৪০ জন। রাজধানী ঢাকাসহ জেলা ও বিভাগভিত্তিক ১৮০টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে; যার সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৬৭৭ জন। ২০২৩ সালে অপরাধের কারণে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে ১৯৭ জন কিশোরকে। এসব কিশোর সাধারণত মাদক বিক্রি ও সেবন, যৌন হয়রানি, চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারি ও খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
রাজধানী ঢাকায় এলাকাভিত্তিক অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। জানা গেছে, কিশোর গ্যাং সদস্যদের তৎপরতা রোধে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে। তাদের আটক করা হচ্ছে। কিন্তু এদের তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে আড্ডা, ইভ টিজিং ও মাদক সেবনে পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। এরা খুনোখুনি, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অপরাধ জগতেও চলছে কিশোর গ্যাংদের দাপট। খুন থেকে ছিনতাই, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে চাঁদাবাজিসহ তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর উত্তরায় আদনান কবির হত্যার পর কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড আলোচনায় আসে। ওই সময় থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর থেকে কিশোর গ্যাং সদস্যদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চলছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কিশোর গ্যাং সদস্যরা একত্রিত হয়ে ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিং করছে। এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের পৃষ্ঠপোষক এবং আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। যখন যেখানে কিশোর গ্যাং সক্রিয় থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে অভিযান চালানো হচ্ছে। তাদের আটকসহ মামলা করা হচ্ছে। পাশাপাশি সংশোধনাগারে পাঠানো হচ্ছে। এসব অপরাধী চক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেকেই থাকে বস্তিতে। তবে সঙ্গদোষে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, কিশোর গ্যাংদের অপরাধ দমনে থানা পুলিশ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যেমন-পুলিশের টহল বৃদ্ধি করা, সম্ভাব্য আড্ডাস্থলগুলোতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রাখা, সন্দেহভাজন কিশোরদের গতিবিধির ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা, অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িতরা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। নানাভাবে তারা অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো বড় ভাইয়ের সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে।