টনপ্রতি এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় কৃষকদের
নড়াইলের বড়দিয়া খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা লিটন মণ্ডল। সরকারি মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ঘুষ নেন। টাকা না দিলে ধান ফেরত দেওয়া হয়, আর টাকা দিলে মানহীন ধানও গুদামে ঢোকে। ওই কর্মকর্তার ঘুষ দাবির একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভুক্তভোগী কৃষকরা জানান, ঘুষের ওই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও কয়েকজন দালাল। সম্প্রতি চেয়ারম্যানের ভাইয়ের সঙ্গে গুদাম কর্মকর্তার দূরত্ব তৈরি হলে তিনিই গোপনে ঘুষ লেনদেনের একটি ভিডিও ধারণ করেন।
ভিডিওতে দেখা যায়, গুদাম কর্মকর্তা লিটন মণ্ডল তাঁর কক্ষে বসে দালালদের সঙ্গে ঘুষের টাকা পাওয়ার জন্য নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের টাকা আমি আলমারিতে তুলে রাখি না।
আমারে কেউ ছাড় দেয় না। গত বুধবারে ২২ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি ডিসি ফুড (জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক) স্যারকে। আগের বৃহস্পতিবারে টিসি এফ (উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক) স্যার এখানে আসছিলেন; উনারে দিছি ১০ হাজার টাকা। টাকা না দিলে উনি সই করবেন না—এটা-ওটা বলতেছেন, উনারা তো কথা বলেন না, উনারা কাজে দেখান।
এক পর্যায়ে গুদাম কর্মকর্তা দালালদের উদ্দেশে বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব আর আপনারা সবাই এই সিদ্ধান্ত (টনপ্রতি টাকা নেওয়া) নিলেন, এখন যদি ধান না দেন তাহলেও আর কাজ চলে না, তাহলে আমি আমার মতো চলি।’
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছরই অ্যাপে লটারির মাধ্যমে সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহের জন্য কৃষক নির্বাচন করা হয়। কৃষকরা সরকারি মূল্যে এক টন থেকে তিন টন পর্যন্ত ধান গুদামে বিক্রি করতে পারেন। এ বছর কৃষকের কাছ থেকে প্রতি মণ ধান এক হাজার ২০০ টাকায় কেনা হচ্ছে। ৭ মে থেকে শুরু হওয়া কার্যক্রম চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় মোট চার হাজার ২৪২ টন ধান সংগ্রহ হওয়ার কথা। আর বড়দিয়া খাদ্যগুদামে সরকারি মূল্যে ৪১১ টন ধান সংগ্রহের জন্য ১৩৭ জন কৃষক নির্বাচন করা হয়। এই গুদামে তিন মাসে ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১৮৬ টন।
তালিকায় নাম থাকা কয়েকজন কৃষক খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে গেলেও ঘুষের টাকা দিতে না পেরে ফিরে এসেছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ধান বিক্রি করেছেন গুদামে।
রামপুরা গ্রামের কৃষক মুজিবর শেখ বলেন, ‘লটারিতে নাম ওঠায় আমি তিন টন ধান নিয়ে গেছি গোডাউনে। আমার কাছে তিন হাজার টাকা ঘুষ চাইলে আমি এক হাজার টাকা দিতে চাই, তা না নিয়ে আমার ধান ফেরত দেওয়া হয়। এতগুলো টাকা দিয়ে বহন করে আবার ফিরিয়ে আনলাম।’
একই গ্রামের মুনসুর শেখ বলেন, ‘গোডাউনে ধান নিয়ে গেলে সেখানে তিন হাজার টাকা ঘুষ চায়। অনেক বলেকয়ে আড়াই হাজার টাকা গুদাম কর্মকর্তাকে দিয়ে বাধ্য হইছি ধান বিক্রি করতে।’
ঘুষের ভিডিও ধারণকারী কোটাকোল ইউপি চেয়ারম্যানের ভাই শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘বড়দিয়া খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা টাকা দিলে খারাপ ধানও নেয়। টাকা না দিলে কোনো কাজ হয় না।’
এ বিষয়ে জানার জন্য গত বৃহস্পতিবার বড়দিয়া খাদ্যগুদামে গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিটন মণ্ডল গুদাম থেকে আরেক সহযোগীকে নিয়ে বেরিয়ে যান। তখন গুদামের ভেতরে থাকা পরিবারের লোকজনের কাছে গেলে দাবি করে, লিটন মণ্ডল খুলনায় গেছেন। পরে ওই কর্মকর্তাকে ফোন দিলেও ধরেননি।
বড়দিয়া খাদ্যগুদামের অধীনে পাঁচটি ইউনিয়ন। তবে গুদাম লাগোয়া দুটি ইউনিয়ন। এর মধ্যে কোটাকোল ইউপি চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ (ভিডিও ধারণকারীর ভাই) ঘুষের ওই সিন্ডিকেটে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন। পাশের খাশিয়াল ইউপি চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহও এ ধরনের চক্রে জড়িত নন বলে দাবি করেন।
খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা লিটন মণ্ডল ঊর্ধ্বতনদের ঘুষ দেওয়ার যে দাবি করেছিলেন, সে বিষয়ে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন নড়াইল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুণ্ডু। তিনি বলেন, ‘সে (লিটন) ভিডিওতে বুধবারে টাকা দেওয়ার কথা বলেছে; সেদিন আমি অফিসেই ছিলাম না। সে টাকা নিছে কি না আমি জানি না, তবে আমি কিংবা আমার অফিস জড়িত নয়।’ তবে এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক।
কালিয়া উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মো. মান্নান আলী বলেন, ‘গুদাম কর্মকর্তা লিটন মণ্ডল কোথায় কী বলেছে, তা আমি জানি না। কোনো লেনদেনের ব্যাপারে আমাকে জড়ালে তা মিথ্যা বলেছে।’