সংঘাতে ইরান-ইসরায়েল, মাঝ থেকে বিপদে জর্ডান
মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী দুই দেশ—ইরান ও ইসরায়েলকে নিয়ে মহাবিপত্তিতে আছে জর্ডান। দেশ দুটির মধ্যে শত্রুতা দিন দিন বাড়ছে। আর এই শত্রুতার জেরে আঞ্চলিক সংঘাত বাড়লে মারাত্মক আঘাত আসতে পারে জর্ডানের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের ওপর।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যদি চূড়ান্তরূপে যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে জর্ডান বড় সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল ইউনির্ভাসিটির জর্ডান–বিশেষজ্ঞ সেন ইয়োম। তিনি বলেন, ‘জর্ডানকে খোলাখুলিভাবে এই ঝঞ্ঝাটের বাইরে থাকতে হবে। যুদ্ধে কোনো এক পক্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে পারবে না তারা।’
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জর্ডান আরেকটা পরিচিতি পেয়েছে। সেটি ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। এ ছাড়া উপত্যকাটিতে পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টাও চালাচ্ছে তারা। তবে এসব কর্মকাণ্ড দেশটির রাজপথে নামা বিক্ষোভকারীদের অতটাও মন ভরাতে পারেনি।
গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এরই প্রতিবাদে জর্ডানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষোভকারীদের দাবি, এই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে আম্মানকে।
‘জর্ডানের মূলনীতি’
এরই মধ্যে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনা জর্ডানের মানুষকে আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
ঘটনাটি ১৩ এপ্রিল রাতের। জর্ডানের আকাশে কয়েক ডজন ইরানি ড্রোন ধ্বংস করে দেশটির বিমানবাহিনী। সেদিন রাতে ইসরায়েল লক্ষ্য করে তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছিল তেহরান।
ইরানের ওই হামলা ছিল ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা জবাব। ওই হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) কয়েক কর্মকর্তা নিহত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিও।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি জর্ডানের বাসিন্দাদের গভীর সহানুভূতি রয়েছে। দেশটিতে আনুমানিক ২০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছেন।
ইরানের ড্রোন ধ্বংসের বিষয়ে জর্ডানের ভাষ্য, তারা নিজেদের সীমান্ত রক্ষায় ওই পদক্ষেপ নিয়েছিল। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছিলেন, ‘ইরানের ছোড়া ড্রোন ও ক্ষেপাণাস্ত্রগুলো জর্ডানের ভূখণ্ডে পড়ার সম্ভাব্য বিপদ ছিল। জর্ডানের সশস্ত্র বাহিনী উপযুক্ত কৌশলে সেই বিপদ মোকাবিলা করেছে।’
১৪ এপ্রিল রাতে ইরান ইসরায়েলের দিকে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়ছবি : এএফপি
আয়মান সাফাদি আরও বলেন, জর্ডানের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। এটি জর্ডানের মূলনীতির বিষয়। ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও একই কাজ করা হবে। হুমকিগুলো ইসরায়েল, ইরান বা অন্য কোনো জায়গা থেকে আসছে কি না, তা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি জর্ডানের বাসিন্দাদের গভীর সহানুভূতি রয়েছে। দেশটিতে আনুমানিক ২০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া দেশটির জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত। এমন পরিস্থিতিতে ১৩ এপ্রিল রাতে ইরানের ড্রোন ধ্বংসের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়েছেন।
জর্ডানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে দেশটির রাজতন্ত্র চাপে রয়েছে। এমনকি ৭ অক্টোবরের আগেও দেশটির ভেতরে ও সীমান্তে বহু চ্যালেঞ্জ ছিল।
জর্ডানের পদক্ষেপে প্রথম দিকে চটেছিল তেহরানও। রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ইরানি বার্তা সংস্থা ফার্স নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের চালানো কোনো অভিযানে নাক গলালে জর্ডানকেও ভবিষ্যতে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে বলে হুমকি দিয়েছে তেহরান।
তবে দ্রুতই নিজেদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেয় দুই দেশ। ইরানের সংবাদমাধ্যম মেহর নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানকে ফোনে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফাদি বলেছেন, ইসরায়েলকে তাদের ‘আকাশসীমার অপব্যবহার করতে দেওয়া হবে না’।
টেম্পল ইউনির্ভাসিটির সেন ইয়োমের ভাষ্যমতে, ইসরায়েলকে সহযোগিতার অভিযোগ তুলে ১৪ এপ্রিল জর্ডানকে সম্ভাব্য হামলার লক্ষ্যবস্তু করার হুমকি দিয়েছিল রেভল্যুশনারি গার্ড কোর। তবে পরদিনই নরম সুরে কথা বলতে শোনা যায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। তিনি জর্ডানকে কূটনৈতিক অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ইরানের সঙ্গে জর্ডানের স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে।
সেন ইয়োম বলেন, ‘আমি মনে করি, সৌদি আরবের মতো জর্ডানও শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে যে ইরানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখার মধ্য দিয়ে তারা সত্যিকার অর্থে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে না।’
কঠিন পরিস্থিতিতে জর্ডান
মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিসরে যুদ্ধ বাধলে জর্ডানও এর শিকার হতে পারে বলে মনে করেন সেন ইয়োম। তিনি বলেন, যুদ্ধ বাধলে দেশটির অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া পর্যটন খাতে আয় কমে গিয়ে এবং বাণিজ্য হ্রাস পেয়ে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে।
১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সেদিন ইরানের ইস্পাহান শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। তেহরান কর্তৃপক্ষ দাবি করে, তিনটি ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে। তবে সেটি বিদেশি কোনো হামলা ছিল কি না, তা উল্লেখ করা হয়নি। ইসরায়েলও ওই হামলার দায় স্বীকার করেনি।
একই দিনে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলেন, ‘আমরা আঞ্চলিক সংঘাত বৃদ্ধির বিপদের বিষয়ে সতর্ক করছি। এ অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়, এমন কোনো পদক্ষেপের নিন্দা জানাচ্ছি। ইসরায়েল ও ইরানের পাল্টাপাল্টি প্রতিশোধ অবশ্যই বন্ধ হতে হবে। গাজায় যে বিপর্যয়কর আগ্রাসন চলছে, তা থামাতে বিশ্বকে মনোযোগ দিতে হবে।’
তবে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে কিছুটা হলেও শান্তি ফিরিয়ে আনার যে চেষ্টা জর্ডান সরকার চালিয়েছে, তাতে তেমন সফলতা আসেনি। জর্ডান নিয়ে তিনটি বই লেখা কার্টিস রায়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিত্রদের নিয়ে জর্ডানের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। এই মিত্ররা একদিকে জর্ডানের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করছে, আবার দেশটির অগ্রাধিকার নীতি ও পরামর্শগুলোর বিরোধিতা করে যাচ্ছে। যেমন জর্ডানের মিত্ররা গাজায় যুদ্ধবিরতিতে ব্যর্থ হয়েছে, আঞ্চলিক সংঘাত দমাতে পারেনি, গাজায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ করে দিতে পারেনি, এমনকি জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ভোটাভুটিতে ভেটোও দিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ঝঞ্ঝাট
সেন ইয়োম বলেন, ‘আমি মনে করি, জর্ডানের বেশির ভাগ নাগরিক মনে করেন, আঞ্চলিক সংঘাতের শিকার হয়েছে তাঁদের দেশ। এই সংঘাত জর্ডান ডেকে আনেনি। আর এই সংঘাত বেড়ে যাক, তা-ও দেশটি চায় না।’
এ নিয়ে কথা বলেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জর্ডানের একজন গবেষক। তিনি জর্ডানের বিক্ষোভের ওপর নজর রাখছেন। ওই গবেষকের ভাষ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে জর্ডানের গভীর নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। সে বিবেচনায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে জর্ডানের পদক্ষেপ দেশটির বেশির ভাগ নাগরিককে অবাক করেনি।
ইরানি ড্রোন ধ্বংসের জন্যও দেশটিতে বিক্ষোভ হচ্ছে না। যদিও এ ঘটনায় অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা করেছেন, তবে বেশির ভাগ জর্ডানবাসীর ক্ষোভটা অন্য জায়গায়।
সেন ইয়োম বলেন, ‘ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে সহায়তার জন্য জর্ডানের কয়েকজন নিজেদের সরকারের সমালোচনা করেছেন। তবে দেশটির বেশির ভাগ মানুষ দোষ চাপিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের ওপর। কারণ, দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ ছাড়া গাজার গণহত্যা তো আছেই।’
এরপরও জর্ডানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে দেশটির রাজতন্ত্র চাপে রয়েছে। এমনকি ৭ অক্টোবরের আগেও দেশটির ভেতরে ও সীমান্তে বহু চ্যালেঞ্জ ছিল। জর্ডানের সাবেক মন্ত্রী ও ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ইব্রাহিম সাইফ বলেন, করোনার পর জর্ডানের অর্থনীতি ধীরে ধীরে চাঙা হচ্ছিল। তবে সাম্প্রতিক যুদ্ধে তা বড় ধাক্কা খেয়েছে।
এখন সবার নজর গাজার দক্ষিণে সীমান্তবর্তী রাফা এলাকায়। সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। তাঁদের আশঙ্কা, খুব শিগগিরই হয়তো রাফায় স্থল অভিযান চালাতে পারে ইসরায়েলি বাহিনী। এমনটা হলে জর্ডানের বিক্ষোভকারীরা আবার রাজপথে নামতে পারেন।
যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক ইউনির্ভাসিটির জর্ডান–বিশেষজ্ঞ জোসে কিরো মার্টিনেজ বলেন, ‘সাধারণত বিক্ষোভ যখন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হয়, তখন (বিক্ষোভকারীদের খুশি করতে) বাদশাহ প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে পারেন। তবে এবার বিক্ষোভকারীদের দেওয়ার মতো তাঁর হাতে কিছু নেই। আর যখন মানুষকে শান্ত করার মতো তাঁর হাতে কিছু থাকে না, তখন ধরপাকড় শুরু করতে পারেন।’
জর্ডানে বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর। অতীতে দেশটিতে ধরপাকড় ও সহিংসতার মাধ্যমে অনেক বিক্ষোভের রেশ কমানো হয়েছে। আর এই বিক্ষোভ যত দীর্ঘ সময় ধরে চলবে, জর্ডানের নিরাপত্তা বাহিনীর আশা থাকবে—বিক্ষোভকারীরা একসময় নিরাশ হয়ে ঘরে ফিরবেন। বিশ্লেষকদের মতে, এটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
সেন ইয়োম বলেন, বিক্ষোভে ক্লান্তির ছায়া দেখা গেছে। অনেক বিক্ষোভকারীর মনে হয়েছে, তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিস্থিতিতে কোনো বদল আনবে না। এমন চিন্তা করে তাঁরা বিক্ষোভ-সমাবেশে ইস্তফা দিয়েছেন।