আবহাওয়ার সব রাডারই নষ্ট
কয়েক দিন ধরে তীব্র গরমে কি মানুষ, কি প্রাণিকুল পুড়ে অঙ্গার হওয়ার অবস্থা। তাপপ্রবাহে প্রাণহানির সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু আবহাওয়া কেমন হবে, কোন সময়ে বৃষ্টি হবে, কোন সময়ে জনজীবন স্বাভাবিক হবে আগাম বার্তা দিয়ে রাখে আবহাওয়া অধিদপ্তর। কিন্তু যে রাডারের মাধ্যমে এ বার্তা দেওয়া হয়, সে রাডারই নষ্ট। জাইকার অনুদানে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা ও রংপুরের নষ্ট দুটি রাডার স্থাপন করার কথা। কিন্তু এ দুটি স্থাপনের আগেই পুরনো সব রাডার নষ্ট হয়ে বিপাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকা, রংপুর, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, রংপুর ও মৌলভীবাজারে পাঁচটি রাডার রয়েছে। ঢাকা ও রংপুরের রাডার দুটি স্থাপন করা হয়েছে ১৯৯৯ সালে। ১৫ বছরে মেয়াদ শেষ হওয়ায় রংপুরে রাডার ইতিমধ্যে অচল। উঁচু ভবন বেশি হওয়ায় রেডিও জ্যামিংয়ের কারণে অকেজো ঢাকার রাডারও। যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে আছে সব রাডারের। বিশ্ববাজারে এসব খুচরা যন্ত্রাংশ আর পাওয়াই যাচ্ছে না। ফলে দুটি পুরোপুরি নষ্ট, বাকি তিনটি প্রায় অকেজো।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঢাকা ও রংপুরে দুটি রাডার স্থাপনের জন্য জাপানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। জাপান সরকার দুটি রাডারের জন্য অনুদান দিতে রাজি হয়। পরে ২০১৫ সালের ২৪ জুন দুই সরকারের মধ্যে একটি অনুদান চুক্তিও হয়। অনুদানের অঙ্ক ছিল ১৮৬ কোটি টাকা।
পরবর্তীকালে ‘ঢাকা ও রংপুরে আবহাওয়া রাডারের উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। সে সময় ২০৮ কোটি টাকায় প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হলেও দুই ধাপে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ২৬০ কোটি টাকায় ঠেকেছে। কিন্তু ২০১৬ সালে হলি আর্টিসানের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে প্রকল্পটিতে ২০২১ সাল পর্যন্ত অর্থায়ন বন্ধ ছিল। এখন নতুন করে এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
সম্প্রতি এ প্রকল্পের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তাদের পর্যবেক্ষণে প্রকল্পটির নানান অসংগতি উঠে এসেছে। এতে ঝুঁকি ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০১৫ সালে প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার সময় পাঁচটি স্টেশনে অন্যান্য রাডার পুরনো হলেও সচল ছিল। তবে নতুন প্রকল্পটি শেষ হওয়ার আগেই বর্তমান সব রাডার নষ্ট হয়ে পড়েছে।
আইএমইডি বলছে, এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। কিন্তু এ রাডারগুলো যে পুরনো, নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, সেগুলো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে উঠে আসেনি কেন? তাছাড়া এখন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই পুরনোগুলো সব একসঙ্গে কীভাবে নষ্ট হলো?
বাংলাদেশের রাডারগুলো যে কাজ করে না, তা গত কয়েক বছরের দুর্যোগের পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় কিংবা অন্য দুর্যোগগুলো সবই বাইরের দেশের বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে জেনেছে বাংলাদেশ। পরে সতর্ক অবস্থানে যেতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর বড় কোনো দুর্যোগের খবর দিতে পারেনি সাম্প্রতিককালে।
আইএমইডির কর্মকর্তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, আগের রাডারগুলো নষ্ট হওয়ায় সঠিক তথ্য বিশ্লেষণের জন্য ঢাকায় এ প্রকল্পের বাইরের তিনটি রাডারের তথ্য সন্নিবেশ করা সম্ভব হবে না। নতুন দুটি রাডার স্থাপনের মাধ্যমে বর্তমানে অন্য তিনটি রাডার স্টেশনের (কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারে স্থাপিত) সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
সংস্থাটি আবহাওয়া অধিদপ্তরকে পরামর্শ দিয়ে বলেছে, এজন্য গাজীপুর এবং রংপুরের মতো এস ব্র্যান্ড ডপলার রাডারসহ অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারের রাডার স্টেশনে সংযোজন করা প্রয়োজন।
ঢাকার ভবনটিতে নতুন রাডার স্থাপন করা হলেও ১৫ তলা সমান উঁচু ভবনে লিফট না থাকায় ঊর্ধ্বতন আবহাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে ওপরে উঠে রক্ষণাবেক্ষণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন আইএমইডি কর্মকর্তারা।
প্রশ্ন হলো, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে কর্মকর্তা না উঠে নষ্ট হওয়া মেশিনের কাজ সারেন কীভাবে। কিংবা সেখানে তারা নিজেরা না উঠে কাকে পাঠান। নাকি কর্মকর্তাদের অবহেলাতেই নষ্ট হয়ে পড়েছে রাডারগুলো।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, রাডারের অপারেশনাল ও টেলিযোগাযোগ কার্যক্রম জনবহুল নগরীর নতুন নতুন উচ্চ ভবনের কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। যথাসময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না করার ফলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তাই এস ডপলার রাডার ব্যবহার করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি।
প্রকল্পটি নিয়ে আইএমইডির, উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে নতুন দুটি রাডার স্থাপনের পরপরই বর্তমানে প্রায় অকার্যকর অন্য তিনটি রাডারের (কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারে স্থাপিত) সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করার লক্ষ্যে তিনটি স্থানে নতুন তিনটি রাডার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রায় ১৫-১৭ তলা উচ্চতার রাডার ভবনে লিফট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া। পর্যাপ্তসংখ্যক আবহাওয়াবিদ ও প্রকৌশলী না থাকায় প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব দূরীকরণে দ্রুত জনবল নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
রাডার যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য না হওয়ায় যন্ত্রপাতিগুলোর টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি সম্পাদন করার পরামর্শও দিয়েছে সরকারের এ পরিবীক্ষণ সংস্থা। তাছাড়া গাজীপুর একটি জনবহুল নগরীতে রূপ নেওয়ায় নতুন নতুন উচ্চ ভবন নির্মাণের ফলে রাডারের অপারেশনাল ও টেলিযোগাযোগ কার্যক্রম যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে ভবন নির্মাণ নীতিমালা অনুসরণে আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাডার নষ্ট হলে ক্ষতিটা কী : রাডারের মাধ্যমে সাধারণত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে আগাম বার্তা দেওয়া হয়। এতে সমুদ্রে মাছ ধরা থেকে শুরু করে কৃষকের মাঠেও অগ্রিম সতর্কতা থাকে। এমনিতেই বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে। দুর্যোগের বার্তা সবার আগেই জানা প্রয়োজন। কিন্তু যেখানে রাডারই নষ্ট সেখানে আগাম বার্তার জন্য বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হবে অন্য দেশের প্রযুক্তিগত তথ্যের ওপর।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘আমাদের কয়েকটি রাডার নষ্ট রয়েছে। জাপানের তত্ত্বাবধানে এগুলো রিপ্লেস (বদলে নতুন করে স্থাপন) করার কাজ চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো রিপ্লেস হবে। রাডারের মাধ্যমে যে তথ্যগুলো নিয়ে থাকি তা এখন অন্যভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘রাডারের কাজই হলো আমাকে তথ্য দেওয়া। সে তথ্য অনুযায়ী আমি আমার কাজ নির্বাচন করব। উৎপাদনগত জায়গায় ঝুঁকি বা অন্য জায়গার ঝুঁকি এখান থেকেই আসছে। এখন রাডারটি আমাকে তথ্য দিচ্ছে না, ফলে আমার কোনো কাজেও আসছে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের তথ্যই যদি না থাকে, কৃষিতে কোন তাপমাত্রা সহনীয়, তাহলে আমি প্রস্তুতি নেব কীভাবে। আমার শরীরে জ্বর আছে, কতটুকু জ্বর তা মাপার জন্য অবশ্যই থার্মোমিটার লাগবে। এ রাডার আমার কৃষিক্ষেত্রে লাগে, পরিবেশের জন্য লাগে, জীবনের জন্য লাগে। যেহেতু রাডারের মাধ্যমে এসব তথ্য নেই, ওই সম্পর্কিত তথ্যে আমার একসেসও নেই। ফলে আমি যত রকমের নেতিবাচক ফল আছে, সবই আমাকে ভোগ করতে হবে।’
এ অধ্যাপক বলেন, ‘এগুলো দেখার জন্য একটি সংস্থা আছে, সেগুলো দেখার জন্য তারা হয়তো দায়িত্ব পালন করে না কিংবা দায়িত্ব পালন করলেও তারা সেগুলো ঠিকমতো করে না।’