Bangladesh

কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ বিএমডিসি!

দেশে চিকিৎসায় অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসার অভিযোগে রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় একমাত্র তদারকি সংস্থা বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। প্রতিষ্ঠানটি কাগজে-কলমে ১৯৭৩ সালে যাত্রা শুরু করলেও ২০১০ সালের আগের চিকিৎসাসংক্রান্ত কোনো অভিযোগের সঠিক নথিভুক্ত তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে ৫২২টি অভিযোগ নথিভুক্ত হলেও অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসার অভিযোগের পৃথক কোনো হিসাব নেই। কিংবা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হাতে গোনা যে কয়েকজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে তা কার্যকর হয়েছে কি না তা-ও দেখার কেউ নেই।

বলা চলে, প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে অনেকটাই ব্যর্থ।

এসবের মধ্যেই ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিএমডিসির নথিতে ৩১২টি অভিযোগের পৃথক হিসাব পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এসব অভিযোগের মধ্যে ২৭৪টির নিষ্পত্তি হয়েছে আর নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৩৮টি।

নিষ্পত্তি করা অভিযোগের মধ্যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ১৮টিতে, আপস বা মীমাংসা করা  হয়েছে ১০টি, অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে চারটি, শাস্তি হিসেবে চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে একটি, বিভিন্ন মেয়াদে নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে ১২টি।

নিবন্ধন সার্টিফিকেট যাচাই করা হয়েছে ৮০টি, অভিযোগ করে পরে যোগাযোগ করেনি আটটি, অবৈধভাবে বিদেশি চিকিৎসক দেশে এসে চিকিৎসা দেওয়াসংক্রান্ত ২৮টি, ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহার ও অন্যান্য ১১৩টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সূত্র জানায়, শাস্তি পাওয়া ১৩ জন চিকিৎসকের মধ্যে একজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এর বাইরে এক বছরের জন্য নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে চারজনের। ছয় মাস ও তিন মাসের জন্য নিবন্ধন স্থগিত করা হয় আটজনের।

তবে নিবন্ধন স্থগিতের সময় শাস্তি পাওয়া চিকিৎসকরা চিকিৎসাসেবা থেকে বিরত ছিলেন কি না তা তদারকি করা হয়নি।

সম্প্রতি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই একই ধরনের ঘটনায় আরো এক শিশু মারা যায়। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যুর এসব ঘটনা ঘটেছে।

চলতি বছরের শুরুর চার মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুল চিকিৎসা কিংবা অবহেলায় অন্তত ২০টি মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— এন্ডোস্কপি করাতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মৃত্যু, নারায়ণগঞ্জে টনসিলের অপারেশন করাতে গিয়ে মৃত্যু, চর্মরোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে স্থপতির মৃত্যু, জয়পুরহাটে পায়ের অপারেশন করাতে গিয়ে রোগীর মৃত্যু, শরীয়তপুরে দুই নবজাতক এবং টাঙ্গাইল ও গোপালগঞ্জে প্রসূতির মৃত্যু।

এসব ঘটনার মধ্যে মাত্র তিনটি ঘটনায় অভিযোগ জমা পড়েছে বিএমডিসিতে। কারণ, বেশির ভাগ মানুষ এখনো জানে না, কোথায় অভিযোগ করতে হয়।

বিএমডিসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ জি এম আনোয়ারউল্লাহর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত বিএমডিসিতে যাঁরা অভিযোগ করেন, বেশির ভাগই করেন ক্ষতিপূরণ চেয়ে। কিছু অভিযোগ পত্রিকা থেকে জেনে নথিভুক্ত করা হয়। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পর অভিযোগ তুলে নেন। বিএমডিসি জানতেও পারে না। অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেই দায়িত্ব শেষ করেন। কখনো খোঁজও নেন না।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘টাকা পয়সা কিংবা জেল দিতে পারে না বিএমডিসি। অভিযোগ প্রমাণ হলে  সর্বোচ্চ নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। এ ক্ষেত্রে টর্ট আইনে মামলা করা যেতে পারে। কিন্তু সময়সাপেক্ষ বলে বাংলাদেশের মানুষ এ আইনে মামলা করতে চায় না।

আইনে যে শাস্তির কথা বলা আছে

১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৩৮ ধারায় চিকিৎসকের অবহেলাসংক্রান্ত অপরাধ প্রতিকারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড কিংবা দুটি একসঙ্গে হতে পারে। দণ্ডবিধির ৮০ ও ৮৮ ধারায় চিকিৎসাকার্যে সংঘটিত দুর্ঘটনার দায় থেকে চিকিৎসককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু হলে ফৌজদারি মামলা করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০২৩ নামে আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে আইনটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই খসড়াতেও চিকিৎসায় অবজেলজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে ফৌজদারি আইনে বিচার এবং আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা হয়েছে। চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে লাইসেন্স বাতিল এবং চিকিৎসকের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে খসড়া আইনে। একই সঙ্গে এসব অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাও দেখতে হবে

বিএমডিসিতে অভিযোগ করেও প্রতিকার মিলছে না, ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘প্রতিকার পাচ্ছে না, এমন অভিযোগ সত্য না, বলতে পারেন দীর্ঘ সময় লাগছে। কারণ, আমাদের সক্ষমতাও আপনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘১৯৮১ সালে মেডিক্যাল কলেজ ছিল আটটি, ডেন্টাল কলেজ ছিল মাত্র একটি এবং মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (এমএটিএস) ছিল পাঁচটি। বিএমডিসিতে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৬৫, দন্ত চিকিৎসক ২০৭। চিকিৎসা সহকারীদের নিবন্ধন তখনো শুরু হয়নি। বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজ ১১৪টি, ডেন্টাল ১৩টি ও ডেন্টাল ইউনিট ২২টি। মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (এমএটিএস) সংখ্যা প্রায় ২১৬টি। নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার ১০৪, দন্ত চিকিৎসক প্রায় ১৩ হাজার, চিকিৎসা সহকারী প্রায় ২৭ হাজার ৯৪২।’

তিনি আরো বলেন, ৮০-৯০ দশকে এই প্রতিষ্ঠানে যে লোকবল ছিল, এখনো তাই আছে। এর মধ্যে আগে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ছিল না বললেই চলে, এখন প্রতি মাসে দুই-তিনটা আছেই। এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে দুই-তিন বছরের বেশি লেগে যায়। কারণ সপ্তাহে সর্বোচ্চ একটা মিটিং করা যায়। তা-ও আবার বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় প্রধানরা সব সময় আসতেও পারেন না।’

সংক্ষুব্ধরা যা বলছেন

গত ১৫ মার্চ রাজধানীর বিজয়নগর বিএমডিসি ভবনে গেলে কথা হয় রুহুল আমিন নামের এক সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি এসেছেন তাঁর মায়ের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ জমা দিতে। অভিযোগ প্রসঙ্গে রুহুল আমিন বলেন, ‘আমার মা হেঁটে চিকিৎসার জন্য আগারগাঁওয়ের একটি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে সেখানে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে এক সপ্তাহ আইসিইউতে থাকার পর মারা যান। কিন্তু এমন কোনো জায়গা কি রাখা হয়েছে যেখানে অভিযোগের প্রতিকার পাওয়া যায়? গত ১০ দিন ঘুরে আমি ওই হাসপাতালের পরিচালকের কাছে অভিযোগ জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। শেষে বিএমডিসিতে এলে তৃতীয় তলার একজন জানান, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন অনুমতি দিলে অভিযোগপত্র জমা নেওয়া হবে।’

খতনা করাতে গিয়ে মারা যাওয়া শিশু আয়ানের মামা মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘বিএমডিসিতে অভিযোগ দেওয়ার পর এক দিন ডাকা হয় আমাদের। এরপর আর খবর নেই। চিকিৎসায় অবহেলা এটি আমরা প্রমাণ করতে পারিনি। অথচ খতনা করাতে গিয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা স্বাভাবিক ঘটনা না। এখন মামলা উঠিয়ে নিতে যত ধরনের চাপ তৈরি করা যায় সেটি করা হচ্ছে।’

বিচার পেতে দীর্ঘসূত্রতার কারণ

বিএমডিসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভিযোগ নথিভুক্ত করার পর সেটি শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে যায়। ওই বৈঠকে বিশ্লেষণের পর অভিযোগকারী ও বিবাদীকে চিঠি দেওয়া হয়। আবার যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে জবাব দিতে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়।

এরপর শুনানির নির্দিষ্ট দিন শৃঙ্খলা কমিটি দুই পক্ষের বক্তব্য শোনে। কমিটি যদি মনে করে তাহলে অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত তদন্ত কমিটি গঠন করে।

বিশেষায়িত তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে শৃঙ্খলা কমিটির কাছে সুপারিশ করে। এভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ। ফলে বিচার পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button