গরমে বদলে যাচ্ছে রাজধানীর মানুষের জীবনযাপন
গরমের কারণে রাজধানী ঢাকার মানুষের প্রত্যাহিক জীবন বদলে যাচ্ছে। গেল চৈত্র মাস থেকে প্রচণ্ড গরম চলছে। সকালের দিকে (সকাল ৭টা থেকে ৯টা) ঢাকার তাপমাত্রা থাকছে ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা যত বাড়ে, তাপমাত্রাও তত বাড়তে থাকে। সাধারণত সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এ অবস্থা চলে। ২টার পর আবার তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। কোনও কোনও দিন ঢাকার তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিতে ওঠার রেকর্ডও হয়েছে।
তাপমাত্রা এত বেশি হওয়ায় সাধারণত মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না বা হচ্ছেন না। এখন বিকালের দিকে তাপমাত্রা কমলে বের হন তারা। যেহেতু সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক দোকানপাট রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ করতে হচ্ছে, তাই এ সময়ের মধ্যেই কেনাকাটা সেরে নিচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন, দিনে চাকরিজীবী ও পেশাজীবীরা ছাড়া সাধারণ মানুষ ঘর থেকে তেমন বের হচ্ছেন না।তারা বিকেলে বের হচ্ছেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ও কাজের জন্য।
গত কয়েক দিন রাজধানীর বেইলি রোড, কাকরাইল ও রাজারবাগের কয়েকটি বিপণিবিতান ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাপমাত্রার জন্য দিনের বেশির ভাগ সময় তারা বাইরে বের হতে পারছেন না। এ কারণে তারা ঘরেই থাকছেন। তাপমাত্রা কমলে বিকাল বা সন্ধ্যার দিকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে বের হচ্ছেন। অবশ্য যারা সরকারি ও বেসরকারি চাকরি করেন এবং ব্যবসা করেন তারা সকালেই বের হন ঘর থেকে।
সম্প্রতি ওমরা হজ পালন করে এসেছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজন জানালেন, সউদী আরবে দিনে তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে দিনের বেলায় সব মার্কেট ও বিপণিবিতান বন্ধ থাকে। বিকালে তাপমাত্রা কমলে দোকানপাট এমনকি খাবারের দোকানগুলো খুলতে শুরু করে। সাধারণত আসরের নামাজের পর রিয়াদ, মক্কা ও মদিনার দোকানগুলো খোলেন। তিনি জানান, ফজরের নামাজের আগে এসব দোকানপাট বন্ধ হয়। ফজরের নামাজ পড়ে সবাই বাসায় চলে যান। সউদী আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে দিনের বেলায় বেশি গরম অনুভূত হয়, সেসব দেশে রাতে দোকান খোলা রাখা হয়। আর দিনের বেলায় দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়।
বাংলাদেশের তাপমাত্রাও দিন দিন বাড়ছে। ফলে আমরাও কি এমনটা অনুসরণ করবো কি না, এমন বিষয় আলোচনায় আসতে পারে মনে করে তিনি বলেন, যদিও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, দেশগুলো নিজস্ব জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আর আমরা বেশির ভাগ জ্বালানি আমদানি করি। তাপমাত্রার জন্য সারা রাত দোকানপাট খোলা রাখতে হলে যে পরিমাণ বিদ্যুতের সংস্থান করতে হবে, তা আমাদের পক্ষে সম্ভব কি না, সেটাও দেখতে হবে।
রাজধানীর মৌচাক মার্কেটে গতকাল সন্ধ্যায় সন্তানদের নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন মোছা. জেসিকা রহমান। সন্ধ্যায় কেন এলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনের বেলায় তাপমাত্রার কারণে বের হওয়া কঠিন। এ জন্য সন্ধ্যার পর ছাড়া বের হওয়া সম্ভব না।
বেইলি রোডে সন্ধ্যায় জুনায়েদ জামশেদ এসেছিলেন মেয়ের জন্য কেনাকাটা করতে। তিনিও জানালেন, দিনের বেলায় এই তাপমাত্রায় বের হওয়া যায় না। এ কারণেই তিনি সন্ধ্যার পর মার্কেটে এসেছেন দরকারি জিনিস কিনতে।
সারা দেশে লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাত ৮টার মধ্যে দোকান বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ফজলে নূর তাপস ঘোষণা করেছেন, রাত ৮টার পর দোকান খোলা রাখলে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। পাওয়ার সেলের তরফ থেকেও রাত ৮টায় দোকান বন্ধের নির্দেশ পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
কয়েক দিন ধরেই দিনের বেলায় রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোয় ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। এসব বিপণিবিতানের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এই গরমে তাদের বিক্রি কমে গেছে। বিকালের দিকে বিক্রি হলেও দিনের বেশির ভাগ সময়ে তাদের বসেই কাটাতে হচ্ছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চলে গেলে তাদের আরও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।
রাজধানীর বেইলি রোডের একটি বিপণিবিতানের বিক্রেতা আবুল কাশেম বলেন, দিনে এখন ক্রেতা আসেই না। চাপ বাড়ে সন্ধ্যার পর। কিন্তু এর মধ্যে আবার ৮টায় দোকান বন্ধ করতে হচ্ছে। তিনি জানান, সারা দিনের কেনাকাটা হচ্ছে মাত্র তিন ঘণ্টা। অর্থাৎ বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে। এ কারণে তাদের বিক্রিও কমে গেছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাজের ধরনের পরিবর্তন করা যায় কি না, জানতে চাইলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, চৈত্র ও বৈশাখে যুগ যুগ ধরে এমন গরম পড়ে আসছে। প্রচণ্ড গরমে সউদী আরব, কাতার কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ দুপুর বেলায় বাইরে বের হয় না। তারা সকাল বেলায় অফিস করে, দুপুর বেলায় ঘুমায়, আর সন্ধ্যার আগে থেকে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত কাজ করে। আমাদের দেশেও এমন করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, নির্মাণশ্রমিকরা দিনে কাজ না করে রাতে বাতি জ্বালিয়ে কাজ করতে পারেন। প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও সন্ধ্যায় করা যেতে পারে। রাত ৮টায় দোকানপাট বন্ধ হলেও বিকালে রোদ কমলে বের হয়েও তো কেনাকাটা করা সম্ভব। এখন তো কোনও উৎসবের সময় নয়। ফলে গরমকে বিবেচনায় নিয়ে এই সময় শুধু দরকারি কেনাকাটা করা উচিত বলেই আমি মনে করি।
এদিকে আবহাওয়া অধিদফতরের ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু জায়গায় এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।