জ্যোতির্বিদ্যার প্রবাদপুরুষ গ্যালিলিও
তাঁর পরিচয়ের তালিকা বেশ দীর্ঘ— গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষক, চিকিৎসক, উদ্ভাবক, লেখক। এককথায় গ্যালিলিও গ্যালিলি ছিলেন রেনেসাঁ যুগের রেনেসাঁ পুরুষ। ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞের সন্তান। শুরুটা হয় পিসাতে মেডিক্যাল ছাত্র হিসেবে।
কিন্তু অতি শীঘ্রই অনুধাবন করলেন তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে আকৃষ্ট হচ্ছেন প্রবলভাবে। চূড়ান্তভাবে শিল্প ও নকশা তাঁকে প্রকৃত নকশা থেকে সরিয়ে নেয়। গ্যালিলির জীবনটা মোটেও সহজ ছিল না। সারা জীবন কেটেছে আর্থিক কষ্টে।
আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত গ্যালিলিও তাই সুলভ মূল্যে কিছু উদ্ভাবনে নেমে পড়েন। এর মাঝে ছিল থার্মোস্কোপ, থার্মোমিটার ও সামরিক কম্পাস।
যদিও তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অন্যতম ক্রীড়নক বা অগ্রদূত ছিলেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করেন।
পদার্থবিজ্ঞানে ‘পড়ন্ত’ বস্তুর সূত্রের জন্য গ্যালিলিও বিখ্যাত। তবে আমরা তাঁকে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং চাঁদের ম্যাপার হিসেবেই বেশি চিনি। জার্মান-ডাচ লেন্সমেকার হ্যান্স লিপারশেই (১৫৭০-১৬১৯)-এর তৈরি টেলিস্কোপের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন গ্যালিলিও। শুক্র গ্রহ ও বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহের পর্যায় পর্যবেক্ষণ করেছেন। মিল্কিওয়ে যে কোটি কোটি নক্ষত্রে পূর্ণ—করেছেন তার ব্যাখ্যা। টেলিস্কোপ দিয়ে প্রথম পর্যবেক্ষণগুলো তাঁর দ্য স্ট্যারি মেসেঞ্জার (১৬১০) বইয়ে তালিকাভুক্ত করেন।
গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বে আকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন। এই তত্ত্বটি প্রস্তাব করে, পৃথিবী, চাঁদ ও বাকি গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে চারদিকে ঘোরে। কোপার্নিকাসের আগে ধারণা ছিল সব গ্রহ বুঝি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে। এই ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে কোপার্নিকাসের তত্ত্বের সাথে গ্যালিলিও নিজের পর্যবেক্ষণগুলো চর্চা করেন। কিন্তু এমন তত্ত্ব প্রকাশ, প্রচার গুরুতর অপরাধ ছিল সেই সময়। ক্যাথলিক সম্প্রদায় তাঁকে এ নিয়ে হুমকিও দিয়ে রাখে, তিনি যেন এগুলো নিয়ে কাজ না করেন। ১৬২৩ সালে গ্যালিলিও তাঁর কাজগুলো সামনে নিয়ে আসেন।
তাঁর বৈজ্ঞানিক ইশতেহার বলে বিবেচিত ‘দি অ্যাসেয়ার’ প্রকাশ পায়। তখনই ‘ধর্মানুভূতিতে’ আঘাত ও প্যারানয়েড পোপ আরবান অষ্টমকে অপমান করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। এবং বলাবাহুল্য তিনি ক্যাথলিক রোষানলে পড়েন। অমানবিক নির্যাতন বা নির্যাতনের ভয়ে ‘অপরাধ’ স্বীকার করানো হয় গ্যালিলিওর মুখ থেকে। দেওয়া হয় আজীবন গৃহবন্দির শাস্তি। শাস্তি দেওয়ার পর তাঁর কাজগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর মাথার ওপর ‘নিষিদ্ধ’ তকমা সেঁটে ছিল। গ্যালিলিওর কাজগুলো খুঁজে পেতে ও পড়তে-জানতে পুরো বিশ্বকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৫৬৪
ইতালির পিসায় জন্ম।
১৫৮১
পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিনে পড়াশোনা।
১৫৮৬
হাইড্রোস্ট্যাটিক ব্যালেন্স উদ্ভাবন।
১৫৯২
থার্মোস্কোপ উদ্ভাবন।
১৫৯২-১৬১০
পাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত, মেকানিকস ও জ্যোতিবিজ্ঞান পড়ান।
১৬১০
প্রকাশিত হয় ‘সাইডেরেস নাঙ্কিয়াস’ (স্ট্যারি মেসেঞ্জার)। যে ছোট্ট বইয়ে তাঁর টেলিস্কোপ পর্যবেক্ষণের বর্ণনা পাওয়া যায়।
১৬১২
নেপচুন পর্যবেক্ষণ। কিন্তু তিনি ধরতে পারেননি এটি একটা গ্রহ।
১৬১৬
‘ডিসকরসো দেল ফ্লুসো ই রেফ্লুসো দেল মারে’ (সমুদ্রের ভাটা ও প্রবাহের ওপর আলোচনা), পরবর্তী সংলাপের ভিত্তি।
১৬১৬
শনির বলয় পর্যবেক্ষণ।
১৬১৬
রোমান অনুসন্ধান-পরীক্ষায় সূর্যকেন্দ্রিকতা বজায়।
১৬১৭
উরসা মেজরে ডাবল স্টার মিরজার পর্যবেক্ষণ।
১৬২৩
Il Saggiatore (The Assayer) প্রকাশিত হয়।
১৬৩২
‘ম্যাসিমি সিস্তেমি দেল মন্ডো’ (দুই প্রধান বিশ্ব-ব্যবস্থা সংলাপ), সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রতিরক্ষামূলক ব্যাখ্যা।
১৬৩৩
রোমান বিচারে ধর্মানুভূতিতে আঘাত আনার ‘অভিযোগে’ গৃহবন্দি করা হয়।
১৬৩৪-১৬৩৮
Discorsi e Dimostrazioni Matematiche, intorno a due Nuove Scienze (Discourses and mathematical demonstrations Relation to two new Sciences) বইটি লিখেছেন। উপাদান-শক্তি এবং গতির জ্যামিতির ওপর তাঁর কাজের একটা সারসংক্ষেপ বইটি।
১৬৩৮
চোখের দৃষ্টি হারান।
৮ জানুয়ারি ১৬৪২
ফ্লোরেন্সে মৃত্যু।
১৭১৮
তাঁর বই ছাপার ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
১৮৩৫
ক্যাথলিক চার্চের নিষিদ্ধ বইগুলোর সূচি থেকে বাদ দেওয়া হয় গ্যালিলিওর বই।