বিদেশি যারা কাজ করছে তাদের পেমেন্ট দিতে না পারায় ভয়াবহ সংকট ডেকে আনছে
ডলার সংকটের কারণে জ্বালানির বিল, বৈদেশিক কোম্পানির মুনাফা, বিদেশি এয়ারলাইন্সের পাওনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫ বিলিয়ন ডলার যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এতদিন গর্বের সাথে দাবি করতো যে দেনা পরিশোধে কখনো খেলাপি হয়নি। সে দাবি এখন আর থাকছে না। ঋণ পরিশোধ করতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জ্বালানির বিল, বৈদেশিক কোম্পানির মুনাফা, বিদেশি এয়ারলাইন্সের পাওনা ডলার যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। বিদেশী যারা কাজ করছে তাদের প্রেমেন্ট ডলার সংকটের কারণে দিতে পারছে না, এটা ভয়াবহ সংকট ডেকে আনছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) কার্যালয়ে সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন স্মরণ ও ‘ব্যাষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ এবং এগিয়ে যাওয়ার উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চারটি ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুদ্রানীতি ও আর্থিকনীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ির বিষয়টিকে ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’ বলে মন্তব্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই আত্মসংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় সরকার বদল, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির জন্য ১৯৯০ এর দশককে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ‘অনন্য দশক’ সমালোচকরাও বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা বোধ করতেন। কারণ তখন নীতিপ্রণেতাদের সঙ্গে সমালোচক, সাংবাদিকদের গভীর ও আস্থার সম্পর্ক ছিল। তিনি বলেন, ১৯৯০-এর দশক গণতন্ত্রের জন্য স্বর্ণযুগ ছিল। বর্তমানে সেটিকে বিশ্রুত মনে হয়। বর্তমানে তথ্য-উপাত্তে অপঘাত হয়েছে। আগে তথ্য-উপাত্তে দৃষ্টিশক্তির অভাব ছিল। এখন বৈকল্য এসেছে। এর সর্বশেষ প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চাইলে এটা করতে পারে না। ঘরেই যদি না ঢোকা যায় তাহলে কী বার্তা পাওয়া যাচ্ছে? এ থেকে বার্তা আসছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যেসব তথ্য-উপাত্ত থাকে সেগুলোর অবস্থা এমন যে, সেগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ পেলে বড় ধরনের নাশকতা হয়ে যেতে পারে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথ্য-উপাত্তের জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছিল। অনেক তথ্য তাৎক্ষণিক পাওয়া যেতো। তার বিশ্বাসযোগ্যতাও ছিল। বিশেষ করে বৈদেশিক লেনদেন সংক্রান্ত। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তুলনায় নির্ভরযোগ্য ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নেয় তাহলে সুনামহানি ঘটবে, এতে সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, রপ্তানি হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, টাকা আসছে না। সাংবাদিকদের মাধ্যমে মানুষ তা জানে। এখন এই তথ্য বন্ধ করা হচ্ছে। এ ধরনের সংবেদনশীল তথ্য নিয়ন্ত্রণ করা হলে সেটা সরকারের জন্য অপকারী। আর বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে এই উদ্যোগ নিয়েছে যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারের সংস্কার উদ্যোগের ফলাফল বিশ্লেষণ করছে। সেসময় প্রবেশ নিষেধ, তার মানে ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।
সিপিডির এ সম্মাননীয় ফেলো বলেন, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এখন এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বোয়িংয়ের চলার মত। সরকারের বিনিয়োগ থেকে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ এগোচ্ছে না। দ্বিতীয় ঘাটতি রাজস্ব আয়ে। জিডিপি বাড়লে আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। এছাড়া অতিমূল্যায়িত প্রকল্প। যেগুলো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করে বাজেট কমছে। যা বাজেট করা হচ্ছে তার ৮০ শতাংশ বাস্তবায়ন হচ্ছে। বর্তমানে জিডিপির ১৬ থেকে ১৭ শতাংশের বেশি সরকারি ব্যয় হয় না। সরকারের অদক্ষতার বড় শিকার হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের সামনে অলৌকিক লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেওয়া হয়। এ বছর মন্দাও চলছে কর আদায়ে।
ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।