পুতিন কি আধুনিক রাশিয়ার ‘জার’ হয়ে উঠছেন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিন প্রথম ক্ষমতায় বসেছিলেন ২০০০ সালে। মঙ্গলবার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে টানা পঞ্চম মেয়াদে ক্ষমতা ধরে রাখলেন তিনি। তাঁর আমলে প্রথম দিকে রাশিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসলেও এখন চিত্র ভিন্ন। দিন দিন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছেন তিনি। বিবিসির রাশিয়াবিষয়ক সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গ মনে করেন, পুতিন আধুনিক যুগের জার (রুশ সম্রাট) হয়ে উঠছেন।
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর গ্র্যান্ড ক্রেমলিন প্যালেস থেকে সেন্ট অ্যান্ড্রুস থ্রোন হল। মাঝের লালগালিচায় মোড়া পথ ধরে হেঁটে গেলেন ভ্লাদিমির পুতিন। শপথ নিলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। এর আগেও চারবার একই পথে থ্রোন হলে গিয়ে শপথ পাঠ করেছেন তিনি। বলা চলে, পুতিন এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে চোখ বেঁধে দিলেও পথটি চিনতে ভুল করবেন না।
মঙ্গলবার এই শপথের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আরও ছয় বছরের জন্য নিজের অবস্থান পোক্ত করেছেন পুতিন। শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত মন্ত্রীসহ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা একতাবদ্ধ ও মহান মানুষ। একসঙ্গে থেকে আমরা সব বাধা পেরিয়ে যাব। আমাদের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব। একসঙ্গে আমরা জিতবই।’
প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিন প্রথম ক্ষমতায় বসেন ২০০০ সালের মে মাসে। তারপর থেকে অনেক কিছুই বদলেছে। সে সময় পুতিন ‘গণতন্ত্র রক্ষা ও সমুন্নত’ করার কথা বলতেন। ২৪ বছর পর এখন সেই তিনিই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন। রাশিয়ার গণতন্ত্র সমুন্নত করার বদলে এর কণ্ঠরোধ করেছেন। পথের সব কাঁটাকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।
পুতিন এখন নিজেকে ‘ভ্লাদিমির দ্য গ্রেট’ বা রাশিয়ার একজন জার (সম্রাট) বলে মনে করেন—এমনটাই বিশ্বাস হোয়াইট হাউসের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ফিওনা হিলের। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি পুতিনের প্রথম দুই মেয়াদের দিকে তাকাই, তাহলে সে সময়ের মূল্যায়নটা মোটামুটি তাঁর পক্ষেই যাবে। তিনি রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এনেছিলেন। দেশকে আবার স্বচ্ছল বানিয়েছিলেন। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে তখন রাশিয়ার অর্থনীতি ও শাসন ব্যবস্থা ভালো ছিল।’
রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের স্পিকার ভিয়াচেস্লাভ ভলোদিন একবার বলেছিলেন, ‘যদি পুতিন থাকেন, তাহলে রাশিয়া টিকে থাকবে। আর পুতিন না থাকলে রাশিয়ার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
তবে ১০ বছর আগে থেকে চিত্রপটে পরিবর্তন আসতে শুরু করে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই কর্মকর্তা। তাঁর মতে, ২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশপন্থী সরকারের পতনের পর ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। তখন নাটকীয়ভাবে পুতিনের পথ বদলে যায়। বাস্তববাদী হওয়ার বদলে তিনি সাম্রাজ্যবাদী একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনফাইল
সেন্ট অ্যান্ড্রুস থ্রোন হলে শপথ অনুষ্ঠানে পুতিনের অনেক সমর্থক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের একজন রুশ পার্লামেন্ট সদস্য পিয়ত্র তলস্তয়। তিনি আমাকে বললেন, ‘পুতিন বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।’ ‘কিসের বিজয়’—জানতে চাইলাম। জবাব দিলেন—‘যখন ব্রিটেন ও পশ্চিমারা বুঝতে পারবে রাশিয়া একটি পরাশক্তি, তখনই বিজয় আসবে।’ আমি আবার প্রশ্ন করলাম—‘পশ্চিমারা যদি বুঝতে না পারে?’। তলস্তয় বললেন, ‘তখন পশ্চিমারা ধ্বংস হয়ে যাবে।’
ক্রেমলিন প্যালেসে পুতিনের একজন বড় ভক্তের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি ভিয়াচেস্লাভ ভলোদিন—রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের স্পিকার। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘যদি পুতিন থাকেন, তাহলে রাশিয়া টিকে থাকবে। আর পুতিন না থাকলে, রাশিয়ার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।’ ওই বক্তব্য দিয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। ভলোদিনের ভাষ্যমতে, ‘পশ্চিমারা একটি দুর্বল রাশিয়া চায়, যেটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সেখানে তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন পুতিন।’
এটা চিন্তা করলে তাক লেগে যায় যে, রাশিয়ায় পুতিন যতদিন ক্ষমতায় রয়েছেন, সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র পাঁচটি প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। যুক্তরাজ্যে সাতবার প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে। পশ্চিমাদের কাছে এখন বড় চ্যালেঞ্জ—রাশিয়ায় দিন দিন আরও কর্তৃত্ববাদী হতে থাকা পুতিনকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা বের করা। পুতিন এখন আধুনিক যুগের জার হয়ে উঠেছেন, যাঁর কাছে পারমাণবিক অস্ত্রও আছে।
শুধু গ্র্যান্ড ক্রেমলিন প্যালেসেই আপনারা কেবল পুতিনকে খুঁজে পাবেন না। মস্কো থেকে ৭০ মাইল দূরে কাশিরা শহরেও তাঁকে পাওয়া যাবে।
ফিওনা হিল বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই করা যেতে পারে। পুতিন যখন ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিলেন; তখন চীন, ভারত, জাপানের মতো কয়েকটি দেশ খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিল এবং পুতিনের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। রাশিয়াকে পারমাণবিক হামলা থেকে বিরত রাখতে আন্তর্জাতিক একটি কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে।
আরও ছয় বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে থাকছেন ভ্লাদিমির পুতিনফাইল
রাশিয়ার খাতা–কলমের হিসাবে গত মার্চের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৮৭ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন পুতিন। এটা উল্লেখ করতেই হয় যে এই নির্বাচনে তাঁর বড় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। আর বৃহৎ পরিসরে এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলাও চলে না। মঙ্গলবার রাশিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের চেয়ারপারসন এলা পামফিলোভার কাছে ঠিক এই বিষয়ই তুলে ধরেছি আমি।’
পামফিলোভাকে আমি বলেছি, ‘নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।’ জবাবে তিনি বলেন, ‘যাঁরা কখনো রাশিয়ায় আসেননি বা লম্বা সময় ধরে এখানে থাকেননি, তাঁরাই কেবল এমন সমালোচনা করবেন। যা বলা হচ্ছে, তার সবই কল্পনা ও মিথ্যা।’
শুধু গ্র্যান্ড ক্রেমলিন প্যালেসেই আপনারা কেবল পুতিনকে খুঁজে পাবেন না। মস্কো থেকে ৭০ মাইল দূরে কাশিরা শহরেও তাঁকে পাওয়া যাবে। এই শহরটিতে একটি আবাসিক ভবনের একপাশে পুতিনের একটি বিশাল প্রতিকৃতি আঁকা। দেখলে মনে হবে, তিনি আপনার ওপর নজর রাখছেন।
শহরটিতে রাস্তার পাশে ফুল বিক্রি করছিলেন ভ্যালেন্তিনা নামের একজন পেনশনভোগী। তিনি বললেন, ‘আমি তাঁকে (পুতিন) পছন্দ করি। তাঁর মাথায় ভালো ভালো পরিকল্পনা আসে। মানুষের জন্য তিনি অনেক কাজও করেন। এটা সত্যি যে, আমাদের পেনশনের অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়। তবে তিনি এক পলকেই সব ঠিক করে দিতে পারেন।’
‘তিনি তো প্রায় ২৫ বছর ক্ষমতায় রয়েছেন’—আমার এ কথার পিঠে তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমরা তো জানি না পুতিনের পর কে ক্ষমতায় আসতে পারেন।’ এ সময় পুতিনের প্রতিকৃতির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ভিক্টোরিয়া নামের এক নারী। তিনি বললেন, ‘রাশিয়ায় আমরা সবাই এভাবেই চিন্তা করি।’ পুতিনকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে আলেক্সান্দার নামের আরেকজন বললেন, ‘এখন কোনো মতামত দেওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে।’
পুতিনের এই প্রতিকৃতির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যতজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই বলেছেন, প্রতিকৃতিটির দিকে এখন নজরও দেন না তাঁরা। কারণ, সেটি দেখতে দেখতে একপ্রকার অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঠিক একইভাবে তাঁরা একজনকেই রাশিয়ার সর্বময় ক্ষমতায় দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন। এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। আর এ পরিস্থিতিতে শিগগিরই পরিবর্তন আসার কোনো লক্ষণও আপাতত দেখা যাচ্ছে না।