Hot

নকল এনআইডি প্রতারণা: বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি হলেও ‘নীরব’ নির্বাচন কমিশন

ডিজিটালাইজেশনের যুগে প্রশাসনের সব কাজ ডিজিটাল তথা অনলাইনে করা হয়। ফলে দেশের নাগরিকদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল সিম কেনা থেকে শুরু করে, স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় ভর্তি, ব্যাংক একাউন্ট, পাসপোর্ট, জমির দলিলসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পেতে এনআইডি অপরিহার্য। এনআইডি হচ্ছে নাগরিকের পরিচয় পত্র এবং এটা ছাড়া কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। গুরুত্বপূর্ণ এই এনআইডি প্রকল্প পরিচালনা করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। অথচ নাগরিকদের মূল পরিচয়পত্র এনআইডি এখন নকল হচ্ছে এবং বেচাকেনা হচ্ছে। টাকা খরচ করলেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ‘নকল এনআইডি’ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে এনআইডি’র ‘নকল কার্ড’ বিক্রিতে গড়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নকল এনআইডি তৈরির বিজ্ঞাপন দিয়ে কার্ড বিক্রি করছে। এই নকল এনআইডি কার্ড তৈরিতে নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত এমন চিত্র আইন-শৃংখলা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে।

নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িয়ে পড়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতিতে। এদের সহযোগিতায় শতাধিক চক্র দেশব্যাপী গড়ে তুলেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে ঘাপটি মেরে থাকা এ চক্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে এনআইডি জালিয়াতি করে অন্যের সম্পত্তি ও ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকার লোন হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হচ্ছে। রাজধানীর বাইরে দেশের বড় বড় শহরগুলোতেও এ সব চক্রের নেটওয়ার্ক রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখা এমন অন্তত এক হাজার ৫৭ জনকে শনাক্ত করেছে, যারা দ্বিতীয়বার এনআইডি কার্ড পেয়েছেন। এ সব চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে এনআইডি শাখার অর্ধশত কর্মচারীকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল এনআইডি তৈরি চক্রদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব না হলে সমাজের অনেক সম্মানিত ব্যক্তি বা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও প্রতারণার শিকার হতে পারেন। কারণ, এনআইডি নকল করা বা জালিয়াতির সাথে জড়িতরা যে কোন ব্যক্তির এনআইডি ব্যবহার করে ব্যাংক লোন, জমি কেনা বেচা এমনকি অনলাইনে জুয়া খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় অপরাধে এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এনআইডি ব্যবহারে ঝুঁকি রয়েছে মারাত্মকভাবে। দ্রুত তদন্ত করে জড়িত নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।

জালিয়াতির এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনআইডি প্রকল্পের অভ্যন্তরে শক্তিশালী চক্র এসব ঘটনায় জড়িত। কিন্তু বরাবরই চক্রটি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। শুধু ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নয়, বড় বড় কর্মকর্তারা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও কখনোই তা সামনে আসে না। এসব কারণে থেমে থেমে চক্রটি জালিয়াতি অব্যাহত রেখেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া তথ্য দিয়ে জাল এনআইডি ও টিন নম্বর তৈরি করে অসাধু চক্র। এসব জাল এনআইডি ও টিন নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে তৈরি করে ফ্ল্যাটের ভুয়া দলিল। পরে এসব ভুয়া দলিল বিভিন্ন ব্যাংকে মর্টগেজ করে মোটা অংকের টাকা লোন নেয় এসব চক্র। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অসাধু এনআইডি কার্ড তৈরির কর্মকর্তা, ভূমি অফিসের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। এ সব চক্র এখন পর্যন্ত ৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক শত কোটি টাকা লোন নেয়ার তথ্য পেয়েছেন সিআইডি ও ডিবির কর্মকর্তারা।

সিআইডি ও ডিবি সূত্র জানায়, দালাল চক্র ও নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বছরের পর বছর ধরে তৈরি করে আসছে নকল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। এনআইডি ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারির অভাব এবং ফাঁক-ফোকর থাকায় নকল কার্ড তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে বলে উঠে এসেছে ডিআইডি ও ডিবির তদন্তে। নকল এনআইডি কার্ড বিক্রি করা হয় এক লাখ ২০ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এগুলো মূলত ব্যবহার করা হয় ব্যাংক ঋণ ও জমি জালিয়াতির কাজে। একাধিক এনআইডি প্রদান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও এই চক্র নাম ও ছবি একই রেখে অন্যান্য তথ্য পরিবর্তন করে নকল কার্ড তৈরি করে। নির্বাচন কমিশনের আইনি শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, তারা ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের আইনি শাখার মাধ্যমে এই কার্ডধারীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫৫৬টি মামলা করেছে এবং কার্ডগুলো ব্লক করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনআইডি অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা গতকাল শুক্রবার ইনকিলাবকে বলেন, জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের ছাড় দেয়া হবে না। প্রতিটি ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মাঠপর্যায়ে অনিয়ম রোধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনায় দুটি করে তদন্ত কমিটি করা হচ্ছে।


সিআইডি’র অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশে ভুয়া তথ্য দিয়ে জাল এনআইডি ও টিন নম্বর তৈরি করে ব্যাংক লোন নেয়া ও জালিয়াতিসহ নানা অপরাধে জড়িত একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে করেছে সিআইডি। এরা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট ফ্ল্যাটের দলিল দিয়ে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৫০ কোটি টাকা। এ সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূলহোতা একজন জয়নাল আবেদীন ইদ্রিস। তার চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ক্রেতা হিসেবে হাজির হন। ফ্ল্যাট কেনার জন্য শুরুতে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বায়না করেন। এরপর ফ্ল্যাটের মালিকানার তথ্য যাচাইয়ের কথা বলে মালিকের কাছ থেকে দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্রের কপি সংগ্রহ করেন। ফ্ল্যাটের মালিকের কাছ থেকে নেয়া দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্রের তথ্য নিয়ে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু লোকদের মাধ্যমে তৈরি করেন জাল দলিল। জয়নাল আবেদীন ইদ্রিস জাল দলিলে কখনো নিজে মালিক হন আবার কখনো চক্রের অন্যান্য সদস্যদের মালিক বানান। এরপর সেই জাল দলিল দিয়ে পাতেন ফ্ল্যাট বিক্রির ফাঁদ। ফ্ল্যাট পছন্দ হলে ক্রেতার কাছ থেকে বায়না বাবদ অগ্রিম টাকাও নেন জয়নাল। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জাল দলিল দেখিয়ে ক্রেতার নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সেই টাকাও আত্মসাৎ করে। গত ৪ মে এ চক্রের মূল হোতা জয়নাল আবেদীন ওরফে ইদ্রিসসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।

নকল এনআইডি তৈরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নকল এনআইডি তৈরির বিজ্ঞাপন দিতো একটি চক্র। ভুয়া এনআইডি তৈরি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। নির্বাচন কমিশনের এক কর্মচারীও রয়েছে ওই চক্রে। গত বুধবার পাবনা থেকে ওই চক্রের ‘মূল হোতা’ লিটন মোল্লা (২৩) এবং বাগেরহাট থেকে জেলার থানা নির্বাচন কমিশন অফিসের ডাটা অপারেটর মো. জামাল উদ্দিনকে (৩৮) গ্রেফতার করে ডিএমপির সিটিটিসি।

ডিএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হারানো এনআইডির কপি উত্তোলন, এনআইডি সংশোধন, জন্ম নিবন্ধনের ডিজিটাল কপি ও নাম সংশোধন এবং করোনার টিকার সার্টিফিকেটের কপি সরবরাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতো ওই চক্র। জামাল উদ্দিনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন অফিসের সার্ভার থেকে তথ্য সংগ্রহ করতো লিটন। ভুয়া এনআইডি, জন্মনিবন্ধন, টিকার সার্টিফিকেটের বিনিময়ে গ্রাহকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতো তারা। গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, গ্রাহকদের সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করতো চক্রের সদস্যরা। এভাবে লিটন কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। জামাল আত্মসাৎ করে ১০ লাখ টাকা। এক প্রশ্নের উত্তরে সিটিটিসির প্রধান বলেন, এই চক্রের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্তরত কিছু অসাধু কর্মচারী জড়িত আছে। এছাড়াও আর কেউ জড়িত কিনা তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যারাই জড়িত থাকুক সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

যেভাবে জালিয়াতি: চক্রগুলো কয়েকটি প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি করে থাকে। এর মধ্যে এনআইডির অনুবিভাগের সংশ্লিষ্টরা সাধারণত ঢাকা বা মাঠ পর্যায়ে গোপন পাসওয়ার্ড জেনে সার্ভারে প্রবেশ করে জালিয়াতির কার্যক্রম সম্পন্ন করে। ক্ষেত্রবিশেষে নকল কাগজপত্র তৈরি করে যাচাইয়ের নামে বৈধতা দেয়। আবার সরকারের প্রভাবশালী বা নির্বাচন কমিশনের প্রভাবশালীদের তদবিরেও তারা জালিয়াতি করে। গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীতে আটকে গেলে এনআইডির বিভিন্ন ডেস্কে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা সম্মিলিতভাবে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের কাছে আত্মীয় পরিচয়ে ফাইল পাস করিয়ে নেয়। মাঠ পর্যায়ে তদন্তের নামে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সঠিক প্রতিবেদন দেওয়া হয়। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা এভাবে নানা পন্থায় জালিয়াতি করে থাকে। এসব জালিয়াতিতে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার কাজে সহায়তা করছে চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাচন কার্যালয়ের বেশ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা। এর আগে চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল রোহিঙ্গাদের ভোটার কাজে সহায়তা করার অভিযোগে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button