Bangladesh

তবুও পাথর কেটে বেঁচে থাকার চেষ্টা জাফলংয়ের ‘খুঁটানিদের’

ছেনি ও হাতুড়ি দিয়ে কেটে ব্যবহার উপযোগী শিলপাটা তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের সোনাটিলা এলাকায়

এক হাতে ছেনি, অন্য হাতে হাতুড়ি। ছেনির ওপর ঠক ঠক করে পিটিয়ে পায়ের নিচে থাকা বড় পাথর কেটে পাতলা করছিলেন মো. এনাম আহমদ (৪৫)। পাশে থরে থরে সাজানো হরেক রকমের কারুকাজ করা পাথরের শিলপাটা ও হামান দিস্তা।

সিলেটের জাফলংয়ের বাসিন্দা এনাম আহমদ বছর বিশেক আগে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। তখন কাঠমিস্ত্রির তেমন কদর পাওয়া যেত না। আয়–রোজগারও ছিল কম। এ জন্য তিনি পাথর কেটে শিলপাটা তৈরির কাজ শেখেন। এর পর থেকে শিলপাটা তৈরি ও বিক্রি করে তিনি নিজের সংসার চালাচ্ছেন। প্রথম দিকে ভালো আয় হলেও এখন বেচাকেনা কম। এতে কষ্টে চলছে সংসার।

জাফলংয়ে পাথর খোদাই করে শিলপাটা ও হামান দিস্তা তৈরির পেশাকে ‘খুঁটানির’ কাজ বলা হয়ে থাকে। আগে এ পেশায় শতাধিক লোক কাজ করলেও এখন হাতে গোনা কয়েকজন সক্রিয় রয়েছেন। সংখ্যায় সেটা ১২ থেকে ১৫ জন। আর এই ব্যবসায় জড়িত আছেন জাফলংয়ের আরও প্রায় ২০ জন।

‘খুঁটানির’ কাজ করা শ্রমিক ও ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে জাফলংয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণ ছিল শিলপাটা ও হামান দিস্তা। জাফলংয়ে তৈরি শিলপাটার দেশব্যাপী খ্যাতি ছিল। এখন সে কদর আর নেই। যন্ত্র ও লোহার তৈরি মসলা বাটার উপকরণে পাথরের শিলপাটা ও হামান দিস্তার চাহিদা কমেছে। একেকজন বিক্রেতা এখন শিলপাটা ও হামান দিস্তা মিলিয়ে মাসে গড়ে ৫০টি বিক্রি করতে পারেন। যদিও প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর আগে একেকজন মাসে ১৫০ থেকে ২০০টি বিক্রি করতেন। বিক্রি কমে যাওয়ায় এ পেশায় থাকা লোকজনের আয় কমেছে। পরিবার–পরিজন নিয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন তাঁরা।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে জাফলংয়ের বিজিবি ক্যাম্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, একসঙ্গে সাতটি শিলপাটার দোকান। জিরো পয়েন্ট যাওয়ার পথে রয়েছে আরও দুটি দোকান। এ ছাড়া কয়েকটি শিলপাটার দোকান বন্ধ রয়েছে। খোলা থাকা দোকানগুলোয় পাথর খোদাই ও কেটে শিলপাটা তৈরির কাজ করতে দেখা গেছে পাঁচজনকে। তাঁদের মধ্যে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরও ছিল।

ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নানা নকশার শিলপাটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে দোকানে। গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের সোনাটিলা এলাকায়

ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নানা নকশার শিলপাটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে দোকানে। গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের সোনাটিলা এলাকায়

ব্যবসায়ীরা জানালেন, জাফলংয়ে দুই ধরনের পাথর দিয়ে শিলপাটা তৈরি হয়। এর একটি যন্ত্র দিয়ে কাটা পাথর দিয়ে, অন্যটি স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত বড় পাথর কেটে। স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা পাথরের শিলপাটার দাম কিছুটা বেশি। আবার যন্ত্র দিয়ে কাটা পাথরের তৈরি শিলপাটা কিছুটা নজর কাড়ে ক্রেতাদের। তবে মান ও টেকসইয়ের দিক দিয়ে স্থানীয়ভাবে হাতে কাটা পাথরের প্রচলন বেশি। মসলা বাটার এসব পাথরের উপকরণ বিক্রি হয় ৪০০ থেকে ২ হাজার টাকা মূল্যে।

প্রায় পাঁচ বছর ধরে ব্যবসার পাশাপাশি খুঁটানির কাজ করছেন পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের শান্তিনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. ইয়াকুব (২০)। তিনি বলেন, শিলপাটা তৈরির যন্ত্র দিয়ে কাটা পাথরগুলো ভারত থেকে আনা হয়। সেগুলো তারা কেনার পর নির্দিষ্ট আকার অনুযায়ী সেখানে ফুল ও কারুকাজ ফুটিয়ে শিলপাটা তৈরি করেন। ওই পাথরগুলো আগে থেকেই যন্ত্র দিয়ে কাটা থাকায় তৈরি করতে বেগ পেতে হয় না। তবে হাতে কাটা পাথরগুলো দিয়ে শিলপাটা তৈরি করতে সময় ও পরিশ্রম—দুটিই লাগে। এ জন্য সেগুলোর দাম কিছুটা বেশি।

ইয়াকুব বলেন, দিনে তিনি যন্ত্র দিয়ে কাটা ১৫টির মতো শিলপাটা খুঁটানির কাজ করতে পারেন। স্থানীয় পাথরের শিলপাটার কাজ করতে পারেন সাত থেকে আটটি।
হামান দিস্তা ও শিলপাটা বিক্রি করা গোয়াইনঘাটের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা বারেক মিয়া (৩৮) বলেন, প্রায় ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে এ ব্যবসা করছেন। প্রথম দিকে মাসে ১৫০টির মতো শিলপাটা বিক্রি হতো। সে সময় বিক্রেতা ও কারিগরের সংখ্যাও বেশি ছিল। তবে বর্তমানে মাসে ৫০টি বিক্রি করতে কষ্ট হয়। তিনি নিজে খুঁটানির কাজ করতে পারেন না। এ জন্য অন্যের ওপরই ভরসা করতে হয়। লোকবল কম থাকায় কাজের দামও বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা বিষয়টি মানতে চান না।

বারেক মিয়া বলেন, শিলপাটার তুলনায় হামান দিস্তার দাম বেশি। বড় পাথর খোদাই করে খুঁটানি শ্রমিকেরা কাজ করেন বলে পারিশ্রমিক বেশি চান, তবে ক্রেতারা সেটি বুঝতে নারাজ।

ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে শিলপাটায় নানা নকশা ফুটিয়ে তোলেন খুঁটানিরা

ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে শিলপাটায় নানা নকশা ফুটিয়ে তোলেন খুঁটানিরা

বারেক মিয়ার দোকানে হামান দিস্তা দাম করছিলেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা রেহেনা বেগম (৪৫)। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী দিদার হোসেনও। পাথর কেটে তৈরি হামান দিস্তার দাম বারেক মিয়া চেয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ টাকা। রেহেনা বেগম বলেছিলেন ২০০ টাকা। দামাদামি না হওয়ায় চলে যাচ্ছিলেন রেহেনা বেগম।

পাথর খুঁটানির কাজ করা এক কিশোর (১৫) জানায়, সে প্রায় পাঁচ বছর ধরে এ কাজ করছে। তার বাবা মারা গেছেন। বাবাও এ কাজ করতেন। ঘরে তার মা এবং ছোট এক বোন আছে। শিলপাটার পাথর খুঁটে দৈনিক সে ২৫০ টাকার মতো আয় করে।

সিলেটের গোলাপগঞ্জ থেকে পরিবারের চারজন সদস্য নিয়ে জাফলংয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন শামীম আহমদ (৫৫)। তাঁরা বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় বাজার ঘুরে শিলপাটার দামাদামি করছিলেন। মাঝারি আকারের একটি শিলপাটা তাঁরা ৯০০ টাকায় কিনেছেন। শামীম আহমদ জানান, আগে এলাকায় মেলা বসত। সে সময় জাফলং থেকে বিক্রেতারা এসব শিলপাটা ও পাথরের তৈরি নানা সামগ্রী নিয়ে যেতেন। জাফলংয়ের পাথরের খ্যাতি থাকায় এখানে তৈরি শিলপাটাও ভালো মানের হয়ে থাকে।

পরিকল্পনা না থাকলেও বেড়াতে এসে চোখে পড়ায় শিলপাটা কিনেছেন উল্লেখ করে শামীম আহমদ বলেন, আগে ঘরে মা-খালারা শিলপাটায় মসলা বেটে রান্না করতেন। সে জন্য রান্নার স্বাদ ছিল অন্য রকম। এখন গুঁড়া মসলায় রান্না হয়। আবার মসলা বাটার প্রয়োজন হলে যন্ত্র দিয়ে বাটা হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d online