মার্কিন অর্থনীতির ভালো দিক, মন্দ দিক, কদর্য দিক
মার্কিন অর্থনীতিতে এখন যে আচরণ দেখা যাচ্ছে, তা রীতিমতো রহস্যময়। লাখ লাখ কর্ম খালির বিজ্ঞাপন আসছে; বেকারত্বের হারও কম। বেকারত্বের হার গত কয়েক দশকে আর কখনোই এতটা দীর্ঘ সময় নিম্নমুখী ছিল না। বেকারত্বের হার কম থাকলে মানুষ ধরে নেয়, অর্থনীতি ভালো করছে। কর্মসংস্থানের হার কমে যাওয়ার সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্পর্ক আছে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব দেখলে ঠিক বোঝা যাবে না, মার্কিন অর্থনীতিতে এখন সতর্কতার জায়গা কোনটি। বিশেষ করে ‘জেন–জি’ প্রজন্মের মানুষের বড় একটি অংশ ক্রেডিট কার্ডে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়ে ব্যয় নির্বাহ করছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে ব্যাংকগুলো এখন তাদের আর ঋণ দিতে চাইছে না।
সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে ভালো খবরের সঙ্গে এমন আরও খবর আসছে, যা দেখে অর্থনীতিবিদদের হোঁচট খেতে হচ্ছে। মার্কিন অর্থনীতির ক্ষেত্রেই এটা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দেশটির অর্থনীতি এখন বেশ চাঙা, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগের অবকাশ রয়েছে।
মার্কিন অর্থনীতির চালচিত্র দেখে অর্থনীতিবিদেরা বুঝেশুনে কথা বললেও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা বিষয়টিকে একদম বিপরীতে মেরুতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথা প্রথমে বলা যায়। ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলছেন, অর্থনীতি চাঙা এবং অতীতে খুব কম সময়েই তা এত ভালো করেছে। যদিও তিনি মাঝেমধ্যে বলেন, এ ক্ষেত্রে আরও কাজ করার অবকাশ আছে। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলে যাচ্ছেন, অর্থনীতি ধসে পড়ছে। সম্প্রতি উইসকনসিনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
দেখে নেওয়া যাক, মার্কিন অর্থনীতিতে প্রকৃত অর্থেই কী ঘটছে:
ভালো দিক
মার্কিন অর্থনীতি নিয়ে কেউ আশাবাদী হলে দেশটির শ্রমবাজারের পরিসংখ্যান তাঁকে আরও আশাবাদী করে তুলবে। এখন দেশটিতে কর্মখালির বিজ্ঞাপন আছে ৮৫ লাখ। প্রাক্-মহামারি সময়ের তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ বেশি। দেশটিতে এখন বেকারের সংখ্যা ৬৫ লাখ। অর্থাৎ বেকারপ্রতি একাধিক কর্ম খালি আছে। মহামারির আগের দশকে এই অনুপাত ছিল গড়ে শূন্য দশমিক ৬; অর্থাৎ তখন খালি কর্মের চেয়ে চাকরিপ্রত্যাশী মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি। এখন বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো।
এ ছাড়া আরও কিছু লক্ষণ দেখলে মনে হবে, মার্কিন অর্থনীতি ভালোই করছে। দেশটির ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘণ্টাপ্রতি গড় মজুরি এখন প্রাক্-মহামারি সময়ের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি। মজুরি বৃদ্ধির হার কমে গেলেও এখন তা মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি।
মন্দ দিক
২০২২ সালের গ্রীষ্মকালে মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ে উঠলেও এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। যদিও ফেডারেল রিজার্ভের ঠিক করা ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আরও বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি হ্রাসের ধারা সম্প্রতি অবশ্য শ্লথ হয়েছে এবং এ ধারা ধীর হয়ে যাওয়ায় ফেডারেল রিজার্ভের গভর্নর ক্রিস্টোফার ওয়ালারসহ নীতিনির্ধারকেরা বিস্মিত হয়েছেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের মধ্যে নীতি সুদহার কমানোর বাস্তবতা তৈরি হবে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতির হার ও অর্থনৈতিক গতি বেশি থাকায় তাঁদের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
তবে এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার আবার কিছুটা কমেছে, এটাকে স্বস্তিকর বলেই মানছেন ক্রিস্টোফার ওয়ালার।
দেশটির ভোক্তারা মনে করেন, আগামী বছর মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম বেড়ে ভোক্তাদের ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু এপ্রিল মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সে মাসে ভোক্তা ব্যয় কমে গেছে। এটা একদিকে থেকে ইতিবাচক হলেও অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কদর্য দিক
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো মার্কিন জনগণের ঋণ বেড়ে যাওয়া। এই যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও প্রবৃদ্ধির চাকা ঘুরেছে অর্থাৎ মানুষ ব্যয় করেছে, তার কারণ হলো মানুষ ঠিক সাধ্যের মধ্যে ব্যয় করছে না। মহামারির সময় মানুষের হাতে প্রণোদনার অনেক অর্থ জমেছিল। সেই অর্থ এত দিন তারা ব্যয় করেছে; কিন্তু সেই অর্থ ফুরিয়ে আসছে। মানুষ এখন ক্রেডিট কার্ডে ঋণ করছে। তবে শুধু তা–ই নয়, সেই অর্থ সময়মতো তারা পরিশোধ করছে না।
সম্প্রতি ফেডারেল রিজার্ভের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ক্রেডিট কার্ডে বকেয়া রাখার পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গেছে। ২০১২ সালের পর এর পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, ক্রেডিট কার্ডের ঋণ বেড়ে যাওয়া অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, এতে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয়ের বড় একটি অংশ ঋণ মেটাতে চলে যাবে। তখন অন্য কিছু কেনার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকবে না। এতে গতি হারাবে অর্থনীতি।