Bangladesh

বিদেশে এক বছরে গেছে ৮৬৪ কোটি টাকা: অর্থনৈতিক মন্দা ও তীব্র ডলার সংকটের মধ্যেও দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের

অর্থনৈতিক মন্দা ও তীব্র ডলার সংকটের মধ্যেও দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের। ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে পুঁজি নেওয়া হয়েছিল ৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ৬৮৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। গত বছর নেওয়া হয়েছে ৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ৮৬৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ওই সময়ে বিদেশে পুঁজি নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ৮৫ লাখ ডলার বা ১০০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ প্রবণতা ডলারের হিসাবে বেড়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। টাকার হিসাবে পরিমাণে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে যেসব উদ্যোক্তা বৈধভাবে বিদেশে পুঁজি নিয়েছে এ হিসাব তার ভিত্তিতে করা হয়েছে। এর বাইরে দেশ থেকে অর্থ পাচার বা বেআইনিভাবে আরও কয়েকশ গুণ বেশি পুঁজি বিদেশে নেওয়া হয়েছে। যা দিয়ে বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ গ্র“প দেশ থেকে ১২০০ কোটি টাকা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার করেছে। ওই টাকায় দেশটিতে তারা পাঁচতারা হোটেল ব্যবসা করছেন বলে জানা গেছে। এ রকম আরও অনেক উদ্যোক্তা দেশ থেকে ব্যাংকের টাকা আÍসাৎ করে বিদেশে পাচার করে সেগুলো দিয়ে ব্যবসা করছেন।

দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নিয়ে বিনিয়োগের যে নীতিমালা করা হয়েছে তাতে শুধু রপ্তানিকারকরাই পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকের হিসাবে ডলারের পর্যাপ্ত প্রবাহ থাকতে হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে বিশেষ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিদেশে পুঁজি নিয়ে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউস খুলতে পারে।
 
প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশ থেকে বিদেশ পুঁজি নেওয়ার পাশাপাশি কিছু মুনাফা দেশে আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই মুনাফা নিয়ে আসছে।

২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়া হয়েছিল ৩ কোটি ১১ লাখ ডলার। ২০২১ সালে তা তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। ২০২২ সালে পুঁজি নেওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমে। ওই বছরে নেওয়া হয়েছিল ৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। গত বছর নেওয়া হয়েছে ৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার। গত এক বছরের ব্যবধানে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ।

বিদেশে বিনিয়োগকৃত পুঁজি থেকে অর্জিত মুনাফা দেশে আনার প্রবণতাও কিছুটা বেড়েছে। ২০২২ সালে মুনাফা আনা হয়েছিল ১ কোটি ২১ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে আনা হয়েছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে মুনাফা আনার প্রবণতা বেড়েছে ২৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের পুঁজির স্থিতি কিছুটা কমেছে। ২০২২ সালে স্থিতি ছিল ৪০ কোটি ডলার বা ৪২৪০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮ কোটি ডলার বা ৪৪৮৪ কোটি টাকা। ওই সময়ে স্থিতি কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় টাকার হিসাবে পুঁজির স্থিতি কমেনি বরং বেড়েছে।  

এদিকে নগদ পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা গত এক বছরে কিছুটা কমেছে। ২০২২ সালে পুঁজি হিসাবে নেওয়া হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ২০২৩ সালে নেওয়া হয়েরেছ ১ কোটি ৭ লাখ ডলার। ওই সময়ে কমেছে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০২০ সালে নেওয়া হয়েছিল ৯১ লাখ ৯০ হাজার ডলার, ২০২১ সালে ৫৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার।

দেশ থেকে নেওয়া পুঁজিতে ব্যবসা পরিচালনা করে অর্জিত মুনাফা ফের বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। ২০২২ সালে বিদেশে পরিচালিত ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ হয়েছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ওই সময়ে মুনাফা বিনিয়োগ বেড়েছে ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

বিদেশে এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানি ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। ২০২২ সালে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা হয় ৬১ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে এ খাতে নতুন  বিনিয়োগ হয়নি। বরং আগের বকেয়া ঋণ থেকে পরিশোধ করা হয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এ খাতে বিনিয়োগ কমেছে ৪৯১ দশমিক ৭ শতাংশ।

বিদেশে পুঁজি নেওয়া ও ফিরিয়ে আনা এ দুটির পার্থক্য হচ্ছে নিট বিনিয়োগ। ২০২২ সালে নিট বিনিয়োগ ছিল ৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে তা কমে দাড়ায় ২ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে নিট বিনিয়োগ কমেছে ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ।

বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের স্থিতি টানা চার বছর বাড়ার পর গত বছরে কমেছে। ২০১৮ সালে স্থিতি ছিল ৩১ কোটি ৫ লাখ ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ কমেছিল। ২০১৯ সালে স্থিতি ছিল ৩২ কোটি ৩৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। যা আগের বছরের  চেয়ে ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালে স্থিতি ছিল ৩২ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে স্তিতি আরও বেড়ে ৩৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার হয়। যা আগের বছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। ওই বছরেরই স্থিতি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০২২ সালে স্থিতি আরও বেড়ে ৪০ কোটি ডলারে দাড়ায়। যা আগের বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে স্থিতি আরার সামান্য কমে দাড়ায় ৩৮ কোটি ৪৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ কম। অর্থাৎ বিনিয়োগের স্থিতি ২-১৮ সালের পর এই প্রথম কমেছে।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশী বিনিয়োগ গেছে হংকংয়ে ২ কোটি ২৩ লাখ ডলার। ওই দেশ থেকে মুনাফাসহ ফিরে এসেছে ২ কোটি ৮১ লাখ ডলার। বিনিয়োগের চেয়ে মুনাফা বেশি এসেছে। ভারতে গেছে ২ কোটি ১১ লাখ ডলার বিনিয়োগ, দেশটি থেকে গত বছর আসেনি কোনো মুনাফা। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছে ৮৯ লাখ ১০ হাজার ডলার। কোন মুনাফা আসেনি। যুক্তরাজ্যে গেছে ৮৮ লাখ ডলার। মুনাফাসহ ফিরেছে ১ কোটি ৩১ লাখ ২০ হাজার ডলার। নেপালে গেছে ৪২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। মুনাফা এসেছে ৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। শীর্ষ ৫ দেশে মোট বিনিয়োগ ৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। মুনাফা এসেছে ৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার।্ অন্যান্য দেশে গেছে ৭৯ লাখ ১০ হাজার ডলার। মুনাফা এসেছে ১৪ লাখ ডলার।

২০২৩ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় বিদেশে সবচেয়ে বেশি পুঁজি গেছে ৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। এর মধ্যে দেশে এসেছে ৪ কোটি ৩২ লাখ ডলার। বিনিয়োগের মধ্যে খনিজ খাতে গেছে ৮৯ লাখ ডলার, রাসায়নিক ও ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার, ট্রেডিং খাতে ৪ লাখ ২০ হাজার ডলার, ট্রেক্সটাইল খাতে ২ লাখ ৩০ হাজার ডলার, ধাতব ও মেশিনারিজ খাতে ২ লাখ ডলার, অন্যান্য উৎপাদন খাতে ৮০ হাজার ডলার, সেবা খাতে ৭০ হাজার ডলার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশে বিনিয়োগ নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ খুব সাবধানে এগুচ্ছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার ১৯৪৭ সালের আইন সংশোধন করে একটি শর্ত যোগ করে বিদেশে বিনিয়োগ নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। কেবল রপ্তানি আয়ের বিপরীতে পর্যাপ্ত ডলারের প্রবাহ থাকলেই বিদেশে বিনিয়োগ নেওয়া যাবে। বর্তমানে ওই আইনের আওতায় ২২টির বেশি দেশে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ গেছে।

এ পর্যন্ত ১৮টি কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button