অর্থনীতির শক্তি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে দেশের দুই কোটির বেশি মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান রয়েছে। শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশই এসএমই খাতে। অবশ্য বিশেষজ্ঞ, ব্যাংকার ও উদ্যোক্তারা বলছেন, এসএমইর সম্ভাবনার অনেকটাই এখনও কাজে লাগানো হয়নি। অর্থনীতির বর্তমান সংকট কাটাতে এ খাতই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
এসএমই এখন কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি বা সিএমএসএমই খাত নামে পরিচিত। সারাবিশ্বেই ছোট ও মাঝারি উদ্যোগই ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল শক্তি। জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বের ব্যবসার ৯০ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের। মোট কর্মসংস্থানের ৭০ শতাংশই এ খাতের। বিশ্ব জিডিপিতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অবদান অর্ধেক।
অর্থনীতিতে অবদান সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ২০১৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৭ জুন ‘আন্তর্জাতিক এসএমই দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদযাপন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য– বহুমুখী সংকটের সময়ে টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে এসএমই খাতের শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা কাজে লাগানো। বাংলাদেশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন এসএমই ফাউন্ডেশন ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর এ দিবস উদযাপন করছে। প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ৭৯ লাখ কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক গড় এবং প্রতিযোগী কিছু দেশের চেয়ে এখনও পিছিয়ে আছে। যেমন– শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান ৫০ শতাংশের বেশি। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ার অর্থনীতিতেও অর্ধেকের মতো অবদান এ শিল্পের। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। ফলে সুযোগ পেলে এসএমই আরও অনেক এগিয়ে যেতে পারে। হস্তশিল্প, পাটপণ্য, চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, সিরামিক, হালকা প্রকৌশলসহ বিভিন্ন সম্ভাবনাময় খাত রয়েছে। এসএমইর বিকাশ ত্বরান্বিত হলে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্যদিকে দেশের রাজস্ব আয় ও রপ্তানি বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পই হতে পারে সবচেয়ে বড় শক্তি। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সংকোচনমূলক পদক্ষেপে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প চাঙ্গা করার বিশেষ পদক্ষেপ নিলে সেই আশঙ্কা দূর হবে।
পাট খাতের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, এসএমই খাতে গুণগত উৎপাদন এবং গবেষণা উৎসাহিত করা গেলে বড় অঙ্কের আমদানি ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব। অন্যদিকে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে পারে এ খাত। এসএমই খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বাড়াতে এবং একই সঙ্গে পণ্য বৈচিত্র্যকরণে বড় অবদান রাখতে পারে। নিম্ন মাত্রার রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতা দূর করতে এসএমই হতে পারে ত্রাণকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসএমই খাত বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসএমই টাস্কফোর্সের বিভিন্ন সভায় এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত বাজেটে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তাদের মতে, ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সহজে ঋণ পাওয়ার সমস্যা রয়েছে। দক্ষতার সংকট রয়েছে। পণ্য বাজারজাতকরণে সমস্যা রয়েছে। উদ্যোক্তা ও কর্মীদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা বলেছেন, পাঁচ বছর মেয়াদি এসএমই নীতিমালা এ বছর শেষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। নতুন নীতিমালায় এসএমই খাতকে চাঙ্গা করার প্রয়াস বাড়বে বলে তাদের আশা।
এসএমই খাতের সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ খাতের কোনো হালনাগাদ ও সুনির্দিষ্ট তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেজ নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রায় এক যুগ আগের অর্থনৈতিক শুমারির (২০১৩) ডেটা এখনও এসএমই খাতের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারির কাজ চলছে।