গ্রিক-রোমানদের এই শহর প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনহীন হয়ে পড়েছিল
গ্রিক দেবী নিম্ফসকে উৎসর্গ করে বানানো ঝরনা
একসময় জর্ডান অঞ্চলের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্র ছিল জর্ডানের জেরাশ। খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকে শহরটির পত্তন হয়েছিল। তখন অবশ্য এখানে স্থানীয় লোকজন বসবাস করত, তারপর এই শহর গ্রিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সময়ের পরিক্রমায় তা রোমানদের হাতেও আসে। তৃতীয় ও চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্মের প্রচার শুরু হয়। ষষ্ঠ শতকে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের সময় শুরু হয় জেরাশের স্বর্ণযুগ। তারপর ক্রুসেড যুদ্ধের সময় শহরটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৭৮ সালের দিকে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনহীন হয়ে পড়ে জেরাশ।
এতক্ষণ ধরে ভ্রমণ গাইড ইয়াসিরের মুখে শোনা এই ইতিহাস একটি ফলকেও চোখে পড়ল। সেখানে চোখ বুলিয়ে সামনে এগোলাম। প্রকাণ্ড একটা ফটক দৃশ্যমান হলো। রোমান সম্রাট হাড্রিয়ানের (৭৬ থেকে ১৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) জেরাশ আগমন উপলক্ষে ১২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই ফটক নির্মাণ করা হয়। হাড্রিয়ানের ফটক তুরস্কেও দেখেছি। এই ফটক পার হয়েই দেখি হিপোড্রোম আর্চ। স্টেডিয়ামের গ্যালারির মতো আর ভেতরে চ্যারিয়ট রেস বা রথদৌড়ের জায়গা। বাইরে চারদিকে ছোট ছোট ঘর। গাইড জানালেন, এগুলো ছিল মার্কেট।
তারপর লম্বা পথে হাঁটা। সূর্যের তাপ গায়ে বিঁধছে। বেশ ধীরপায়ে এগোচ্ছি। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি আরেকটি ফটক। এটিই মূল জেরাশ নগরীর প্রবেশদ্বার, যা সাউথ গেট নামে পরিচিত। ফটক দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকের পাহাড়ের ওপর দেখি গ্রিক-রোমান দেবতা জিউসের মন্দির। সংস্কারের কাজ চলছে।
জিউস মন্দির পার হয়ে দেখা মিলল ডিম্বাকৃতির পাথরে বাঁধানো বিশাল চত্বর, নাম ওভাল প্লাজা। এটি ছিল শহরবাসীর মিলনস্থল। সেখানকার চত্বরের পাথরগুলো দেখিয়ে ইয়াসির বলছিলেন, ছোট পাথরের ব্লকগুলো গ্রিক সময়ের আর বড় পাথরের ব্লকগুলো রোমান। ওভাল প্লাজার মধ্যে উড়ছে জর্ডানের পতাকা। এটিকে ফোরাম কার্ডোও বলা হয়। এই চত্বরের পূর্বে ২৪টি ও পশ্চিম পাশে ৩৫টি কলাম রয়েছে খিলান দিয়ে বাঁধানো।
ওভাল প্লাজা থেকে আবারও সোজা একটি পথ। তবে গাইডের নির্দেশে বাঁ দিকে যেতেই চোখ ছানাবড়া। বিশাল এক রোমান থিয়েটার। অক্ষত অবস্থায়ই রয়েছে। থিয়েটারে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বেদুইন পোশাক পরা দুই ব্যক্তি পাইপ বাজানো শুরু করল। বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরি সুউচ্চ গ্যালারি। পাথরের মঞ্চ। মঞ্চের সামনে খোলা চত্বর। একপাশে প্রবেশপথ, আরেক পাশে গ্রিনরুম। শুনেছিলাম, মঞ্চ থেকে কথা বললে গ্যালারির শেষ প্রান্তে বসা দর্শকও শুনতে পেতেন। সেটা পরীক্ষা করে বিস্মিত হলাম।
১৮৭৮ সালের দিকে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনহীন হয়ে পড়ে
রোমান থিয়েটার থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকের পথ ধরলাম। গন্তব্য দেবী আর্তেমিসের মন্দির। তুরস্কেও দেখেছি আর্তেমিসের মন্দির, তবে একদম ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর্তেমিসের মন্দির দেখার আকুলতার কারণ হলো, গ্রিক পৌরাণিক এই দেবী আমার পরিচিত একটি নাম। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে ‘গ্রিক অ্যান্ড রোমান ক্লাসিকস ইন ট্রান্সলেশন’ কোর্সে বহুবার আর্তেমিসের নাম এসেছে।
আর্তেমিস ছিলেন শিকার, সতীত্ব, সন্তান জন্মদান, বন্য প্রাণী আর প্রান্তরের দেবী। এই আর্তেমিসকেই রোমানরা বলে ডায়না। প্রায় সব গ্রিক দেবী-দেবতার ভিন্ন রোমান নাম রয়েছে। এই মন্দির থেকে পুরো জেরাশ শহর দেখা যায়। ধ্বংস হওয়ার পর নতুন করে যে নগরী গড়ে উঠেছিল, চারদিকে তার একটি দারুণ প্যানারোমিক ভিউ দেখা যাচ্ছিল।
আর্তেমিসের মন্দির থেকে উত্তর গেট দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম জেরাশ শহরের মূল সড়কে। নাম কার্ডো ম্যাক্সিমাস। গ্রিক ‘কার্ডিয়া’ অর্থ ‘হৃদয়’। আধুনিক বিশ্বে ‘কার্ডিওলজি’ শব্দটি এখান থেকেই এসেছে। এই পথ এমনভাবে তৈরি যেন দুটি রথ পাশাপাশি চলতে পারে। পথের দুই পাশে হাঁটার পথও ছিল। বোঝা যায়, একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক শহরের মতো পথের পাশে মার্কেট ছিল।
কিছু দূর এগোনোর পর চোখে পড়ল একটি গির্জার ধ্বংসাবশেষ। ইয়াসির জানালেন, এটি সেন্ট মেরির গির্জা। পাশেই রয়েছে জেরাশের সবচেয়ে বড় গির্জা সেন্ট থিয়োডোর। এরপর আরেকটি স্থাপনা দেখতে পেলাম। এটি নিমফিয়াম (কৃত্রিম ঝরনা, এর পানিতে নাকি জলপরিদের নাচ–গান চলত)। গ্রিক দেবী নিম্ফসকে উৎসর্গ করে এই ঝরনা নির্মাণ করা হয়েছিল ১৪১ খ্রিষ্টাব্দে।
পুরো কার্ডো ম্যাক্সিমাসেই পাথরের পথ, পাথরের স্থাপনা, বিশাল বিশাল পাথরের ব্লক। এখানকার প্রতিটি পাথরের ইতিহাস রয়েছে, সব ইতিহাস জানতেও ইচ্ছা করছিল। কিন্তু এই ক্ষণিকের ভ্রমণে তা কীভাবে সম্ভব!
ধীরে ধীরে হেঁটে আবার এলাম ওভাল প্লাজায়, তারপর দক্ষিণের ফটক পার হয়ে বারবার পেছন ফিরে দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল, কী যেন ফেলে যাচ্ছি, কী যেন রয়ে গেল। এ অনুভূতি আমার নতুন নয়। প্রতিটি প্রত্নস্থল ভ্রমণ শেষেই এমনটি মনে হতে থাকে। হাড্রিয়ান গেটের কাছে এসে পেছন ফিরে হয়তো শেষবারের মতো দেখে নিলাম জেরাশ নগরীকে।