International

অবিলম্বে হামাসের সঙ্গে চুক্তির দাবি, নেতানিয়াহুকে উৎখাতের দাবিতে উত্তাল ইসরাইলে সড়ক অবরোধ বিক্ষোভ

ইসরাইলি বিক্ষোভকারীরা গাজায় জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য একটি চুক্তির জন্য চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরপর দ্বিতীয় দিন ‘আমরা হাল ছাড়ব না’ সেøাগান দিয়ে তেল আবিব এবং জেরুজালেমের মধ্য দিয়ে মিছিল করেছে। যুদ্ধ দশম মাসে প্রবেশ করার সাথে সাথে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে একটি যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি-মুক্তি চুক্তি বা পদত্যাগ করার আহ্বান জানায়। দেশব্যাপী ‘বিরতি দিবস’ শুরু হয় সকাল ৬:২৯টায় হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণ শুরুর সাথে মিল রেখে যা যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিল। ইসরাইলের দুটি বৃহত্তম শহরে বিক্ষোভকারীরা রাস্তা অবরোধ করে, হাজার হাজার প্রধান চৌরাস্তা এবং কেন্দ্রীয় তেল আবিবের একটি হাইওয়েতে যান চলাচল বন্ধ করে যেখানে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পানিকামান ব্যবহার করে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে, যাদের মধ্যে অনেকেই জিম্মিদের সাথে সম্পর্কিত, এমন একটি ধারণা ছিল যে সরকার ফিলিস্তিনি জঙ্গি হামাসের দ্বারা গাজায় বন্দী থাকা ব্যক্তিদের ছেড়ে দিয়েছে। ইসরাইল বলেছে ১১৬ জন বন্দী রয়েছে, যার মধ্যে ৪২ জন সামরিক বাহিনী মৃত বলে জানিয়েছে।

তেল আবিবে পতাকাবাহী বিক্ষোভকারীদের সাথে যোগদানকারী অরলি নাটিভ (৫৭) বলেছেন, ‘মানুষ কী ভাবছে সরকার তা চিন্তা করে না এবং তারা গাজা থেকে আমাদের বোন এবং ভাইদের ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু করে না’।

অনেকে ইসরাইলের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে রাজনৈতিক টিকে থাকার বিষয়টি হিসাবে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার জন্য আরো বেশি কিছু না করার অভিযোগ করেন। তার মন্ত্রিসভার দুই উগ্র ডানপন্থী সদস্য যদি কোনো চুক্তি হয় তাহলে পদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছেন। জেরুজালেমের সমাজকর্মী নুরিত মেরি (৫০) বলেছেন, ‘তিনি জানেন, যদি তিনি যুদ্ধ শেষ করেন তবে তার সরকারের পতন ঘটবে’। তিনি একটি ইসরাইলি পতাকা বহন করেছিলেন এবং জেরুজালেমের প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির উদ্ভট মিছিলে ‘তাদের বাড়িতে নিয়ে আসুন’ টি-শার্ট পরেছিলেন, যেটির লেজ ছিল একদল তরুণ ধর্মীয় পুরুষ ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে চিৎকার করে। মেরির চাচাতো ভাই ৭ অক্টোবর পরিবার পরিদর্শন করার সময় খুন হন এবং তার ছেলে শিগগিরই তার বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা শুরু করে।

গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করে সেখানে আটক ইহুদিবাদী পণবন্দিদের মুক্ত করে নেয়ার দাবিতে ইসরাইল জুড়ে বিক্ষোভ চলছে। গত রোববার অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা রাজধানী তেল আবিবের একটি প্রধান হাইওয়ে বন্ধ করে দেয়। তারা যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার উৎখাতের দাবি জানায়। তেল আবিবের বিক্ষোভকারীরা রোববার নগরীর আয়ালোন হাইওয়ে বন্ধ করে দেয়। মহাসড়কটি তেল আবিবের উত্তর অংশের সঙ্গে দক্ষিণ অংশের সংযোগ স্থাপন করেছে। বিক্ষোভকারীরা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে উত্তেজনাকর সেøাগান দেয়। এর আগে শনিবারও তেল আবিবে বিক্ষোভ করে ইহুদিবাদী প্রতিবাদকারীরা। তারা নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়ে হামাসের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করার দাবি জানায়।

তেল আবিব থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যাচ্ছে, নেতানিয়াহু ছাড়া ইহুদিবাদী ইসরাইলের সকল শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে চায়। কিন্ত নেতানিয়াহু তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থে চুক্তি করতে দিচ্ছেন না। তেল আবিবের বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধবিরতি চুক্তি প্রতিহত করার জন্য নেতানিয়াহু যেসব প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তা বানচাল করে দেয়ার জন্য ইসরাইলি সেনা কমান্ডারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। খবরে বলা হয়, আন্দোলনকারীরা ইসরাইলে নির্বাচন এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ইসরাইল সরকারের চেষ্টা আরো বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছে।

এদিকে এই মিছিল সমাবেশকে ঘিরে নেতানিয়াহুর জেরুজালেমে আবাসিক ভবনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা একটি মহাসড়কে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পানি কামান ব্যবহার করে পুলিশ। গাজায় ইসরাইলের হামলা ১০ মাসে গড়াল। গত নভেম্বরে এক সপ্তাহের একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি ছাড়া এই দীর্ঘ সময় জুড়ে ইসরাইলি বাহিনী হামলায় আর কোনো বিরতি দেয়নি। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চললেও গাজায় হামলা চালিয়েই যাচ্ছে ইসরাইল। গাজার একটি স্কুলে ইসরাইলের বিমান হামলায় অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছে। মধ্য গাজার নুসাইরাত শরণার্থীশিবিরের ওই স্কুল ভবনটিতে বহু বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। জিম্মি মুক্তি ও গাজায় যুদ্ধবিরতি দিতে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে থাকার পরও নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি জনপদটিতে হামলা চালিয়েই যাচ্ছেন।

নতুন যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতাকারীরা হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে বেশ কয়েকবার সমঝোতা করানোর চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। সম্প্রতি ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু করেছে মধ্যস্থতাকারীরা। হামাসের হাতে এখনো ১১৬ জন জিম্মি রয়েছে। তাদের মধ্যে ৪২ জন মারা গেছে বলে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলছে। গাজায় ইসরাইলের প্রাণঘাতী হামলা থামাতে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতাকারীরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিসরের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার বরাতে দেশটির আল কাহেরা সংবাদমাধ্যম গত শনিবার গভীর রাতে জানায়, কায়রো যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তিসংক্রান্ত অসামান্য দিক আলোচনা করতে ইসরাইলি ও মার্কিন প্রতিনিধিদের আতিথেয়তা করছে মিসর। চলতি সপ্তাহে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করার পাশাপাশি মধ্যস্থতাকারীরা হামাসের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। তবে এ বিষয়ে আর কোনো বিস্তারিত বিবরণ দেয়নি সংবাদমাধ্যমটি। ইসরাইলও যুদ্ধবিরতি আলোচনা চলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তারা জানায়, আগামী সপ্তাহে তারা কাতারি মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে দোহায় ইসরাইলি প্রতিনিধিদল পাঠাবে। যদিও নেতানিয়াহুর মুখপাত্র গত শুক্রবার বলেছেন, যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি নিয়ে হামাসের সঙ্গে তাঁদের মতের এখনো ব্যবধান রয়েছে। গত মে মাসের শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি এবং ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে হামাসের হাত থেকে জিম্মি মুক্তির একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বাইডেনের এ প্রস্তাব নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে আলোচনা থমকে যায়। তবে গত বৃহস্পতিবার এক মার্কিন কর্মকর্তা হামাসের একটি নতুন প্রস্তাবের কথা জানান। এ প্রস্তাব আলোচনা প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে এবং চুক্তিতে পৌঁছানো ভিত্তি তৈরি করতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন মার্কিন কর্মকর্তা। ইসরাইলের অবিরাম বোমাবর্ষণে গাজায় মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। ধ্বংস, মৃত্যু আর অনাহারের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে জনপদটি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় এ পর্যন্ত ৩৮ হাজার ১৫৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৮৭ হাজার ৮২৮ জন। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বলছে, ইসরাইলের হামলার কারণে গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। জনপদটিতে তীব্র খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বলছে, গাজার অন্তত পাঁচ লাখ মানুষকে ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধা’ সহ্য করতে হচ্ছে। গাজার বেশির ভাগ হাসপাতালগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button